পদ্মা সেতু কীভাবে তৃণমূলের মানুষের জীবন বদলে দেবে সেই আলোচনা খুব বেশি একটা হচ্ছে না। তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে সংযুক্তিতে রাজধানীর মানুষ কীভাবে উপকৃত হবেন, সেই আলোচনা হওয়াটা খুব প্রাসঙ্গিক। এই সেতু শুধু পদ্মার এপার আর ওপারকে জুড়ে দেয়নি বরং মানুষের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর পথ খুলে দিয়েছে।
শুরু করি এখান থেকেই। আপনারা নড়াইল কিংবা গোপালগঞ্জের বিলের কই মাছ খেয়েছেন? বলবেন নিশ্চয় কেন? কই মাছ তো জীবনে বহু খেয়েছি। ওখানের মাছের আবার বিশেষত্ব কী? তাহলে বলছি শুনুন- বছর ১০ আগের কথা, ঢাকার এক নামি হোটেলে খেতে গিয়েছিলাম। একটি কই মাছের দাম চেয়েছিল ৫০০ টাকা। জানতে চেয়েছিলাম এত দাম কেন? কী আছে এই কই মাছে। বলল এটা গোপালগঞ্জের কই মাছ। এবার নিশ্চয় আপনারও খেতে ইচ্ছা করছে। শুধু কই কেন শিং, মাগুর, পুঁটি, শোল সব ধরনের দেশি মাছ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিলে যেভাবে আপনা থেকে হয় অন্য এলাকায় এসব খুব একটা দেখিনি। এখনো ঢাকাতে এসব মাছ সাত হাত ঘুরে আসে। বরফের স্তর যতটা পুরু হয় স্বাদ ততটাই কমে যায়। আমরা স্বাদ যেমন ঠিকঠাক পাই না তেমনি সারা দিন সারা রাত খেটে জেলেরা যা পাওয়া উচিত তাও পায় না। নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি একবার খেলে সেই স্বাদ বহু দিন আপনার জিহ্বায় লেগে থাকবে। সারাজীবন গল্প করতে পারবেন। গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর, শরীয়তপুরের মিষ্টি দই খুব বিখ্যাত। আর ঘি এর কথা কী আর বলব। আমাদের এলাকার খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে যদি লুচি ভেজে খান না, দেখবেন সাত দিন তুড়ি বাজাতে পারছেন না।
সেদিন যমুনা সেতু হয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম রাত তখন ১টা কি ২টা হবে। উত্তরবঙ্গ থেকে শত শত ট্রাক ঢুকছে। কোনোটিতে মুরগি, কোনোটিতে ডিম বা সবজি। কিন্তু আমাদের ওদিকে এই চিত্র একদিন দেখা যেত না। কেবল বরিশাল, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা এবং সাতক্ষীরা থেকে কিছু মাছ আসত। পদ্মা সেতু আমাদের দুই পাড়কে সংযুক্ত করে দিয়েছে। এবার নিশ্চয় পরিবর্তন ঘটবে। আর কিছু না হলেও কৃষিভিত্তিক ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠবে।আমাদের জেলেদের নিশ্চয় এরপর থেকে আর মাঝখানের মানুষদের সব দিয়ে দিতে হবে না। এখন রাতে মাছ ধরে সকালে ঢাকায় চলে আসতে পারবে। আবার সন্ধ্যাবেলা পদ্মার হাওয়া খেতে খেতে ঢাকা ছাড়তে পারবে। সঙ্গত কারণে যে মানুষটির মাছ ১০০ টাকা বিক্রি হতো এখন তা কমপক্ষে ৫০০ টাকা বিক্রি হবে। ফলে মানুষের আয় বেড়ে পাঁচ গুণ হবে। এখন বলুন এই পাঁচ গুণ আয় কি তার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবে না? মানুষের হাতে যখন টাকা আসে তখন তার জীবন-মানের পরিবর্তন ঘটে। পদ্মা সেতু আসলে সেই কাজটিই করবে। এখন থেকে ময়রা আর কৃষাণি স্বপ্ন দেখতেই পারে তার তৈরি পণ্য মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় চলে আসবে। ফলে বাড়তি আয়ে নতুন জীবনের এক জয়গানে তারা শামিল হবে।
আপনি যদি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ হয়ে থাকেন তো দেখবেন ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-ফরিদপুর এবং ঢাকা-বরিশাল রুটে রাস্তার দুই ধারে প্রচুর জমি রয়েছে। এসব জমিতে সাধারণত ধান এবং পাট উৎপাদন হয়। কৃষক ধান এবং পাটের খুব ভালো বাজার দর পায় না। ফলে সে অর্থনৈতিকভাবে মার খায়। ইদানীং একটি বড় সমস্যা হচ্ছে পানির প্রাপ্যতা। কৃষক পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারে না। ফলে সে পাট নিয়ে বিপাকে পড়ে। এরপর পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কৃষক ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, তার আসলে কী আবাদ করা উচিত।
অন্যদিকে ঢাকা এবং তার আশপাশের জেলাগুলোর দিকে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে সাভার, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপকভাবে সবজির আবাদ হয়। এসব এলাকার কৃষক ধনাঢ্য। এক বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করে বছর শেষে ৩ লাখ টাকা আয় করেন। সেখানে একই ধরনের জমিতে ধান বা পাটের আবাদ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকের বিঘাতে সব খরচ বাদ দিয়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা টেকানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে কৃষক হাইভ্যালু ক্রপস বা দামি শস্য আবাদ করতে গেলেও বিপণন নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে বড় বাজার ঢাকাতে পণ্য পৌঁছানো দুঃসাধ্য ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেরিঘাটে দুই-তিন দিন এমনকি কখনো কখনো সাত দিন পর্যন্ত ট্রাক আটকে থাকে। ফসল যেমন পচে যায়, তেমনি কৃষকের স্বপ্নও পুড়ে যায়। ফলে রাস্তায় সব কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যেত। বিপণন ব্যবস্থার জটিলতার কারণে কৃষক এসব ফল ফসলের আবাদ করতে রাজি হতো না। সে মনেই করত ধান বা পাট চাষ করলে অন্তত এটি বাজারে তোলার আগেই পচে নষ্ট হবে না। সেদিন কিন্তু এখন শেষ হয়ে গেল। অভ্যন্তরীণ সবচেয়ে বড় বাজার ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠাতে কৃষি নতুন মাত্রা পাবে। শুধু বাংলাদেশের বাজার নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ এলাকায় গড়ে উঠতে পারে অ্যাগ্রো প্রসেসিং জোন। ইতোমধ্যে যশোরের সবজি চাষিরা দেখিয়েছেন কীভাবে এক জমিতে বছরে পাঁচটি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। পুরো এলাকার জমির ধরনও একই, কেবল দরকার ছিল বাজার। সেটি এখন কৃষকের হাতের নাগালে চলে এলো। ফলে কৃষকের মাথায়ও নতুন চিন্তা যোগ হবে।
সাধারণত ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের কাজ খুব কম হয়ে থাকে। আর হলেও তৃণমূলের কৃষকের কথা ব্যবসায়ীরা চিন্তা করেন না। উল্টোদিকে সরকার যদি চিন্তা করে তাহলে এখানে একটি অ্যাগ্রো প্রসেসিং জোন করলে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পণ্য বিক্রি করা সম্ভব। অর্থাৎ তখন যে জমিতে ২০ হাজার টাকা আয় হতো এখন সেখানে হাইভ্যালু ক্রপস আবাদ করলে আয় হতে পারে ৫ লাখ টাকা। কৃষকের ভাগ্যের চাকা ঘুরলে দেশের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে বাধ্য।
অন্যদিকে ঢাকা-গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতে যেতে শুধু শিল্পকারখানা দেখতে পাওয়া যায়। আবার এপাশ দিয়ে সাভার-মানিকগঞ্জ ওপাশ দিয়ে ঢাকা-নরসিংদী সবখানেই এ অবস্থা। জ্বালানি থাকার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা শিল্পবান্ধব হওয়াতে কারখানা মালিকরা এই দিকটিই বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ওপারে গেলে পথের ধারে যেসব হাটবাজার চোখে পড়ে সেগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষের মলিনতা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এ দুই এলাকার মানুষের দিকে তাকালেই অর্থনৈতিক বৈষম্য চোখে পড়ে। সোজা কথা হচ্ছে পদ্মা-যমুনা ধরে যদি দেশের মাঝখান দিয়ে একটি রেখা টানা হয় তাহলে ঢাকা ময়মনসিংহ-সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা যতটা সমৃদ্ধ ঠিক বরিশাল, খুলনা, রংপুর, রাজশাহীর ততটাই খারাপ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর উত্তরবঙ্গের অবস্থা কিছুটা ফিরলেও এখনো ব্যতিক্রম রয়ে গেছে খুলনা এবং বরিশালের অবস্থা। এর মূল কারণ যোগাযোগব্যবস্থা এবং জ্বালানি সংকট। সরকার পদ্মা সেতু দিয়ে গ্যাসলাইন নিচ্ছে। অর্থাৎ গ্যাস পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা হচ্ছে। সব এলাকাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদি গ্যাস যায় তাহলে নিশ্চয় পদ্মার ওপারে এবার শিল্পও যাবে।
আমরা সেই পরিবর্তিত সময়ের প্রতীক্ষায় দিন গুনছি। নিশ্চয় আগামী দিনগুলোতে আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনের রং বদলে যাবে।
লেখক : (সাংবাদিক ও নাট্যকার) [email protected]