॥ তিন ॥
আফজালের সঙ্গে পরিচয় ’৭৪ সালে। মতিঝিলের ‘অবজারভার ভবন’ থেকে বেরোয় দৈনিক ‘পূর্বদেশ’। এই পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’। কয়েক মাস আগে ‘চাঁদের হাট’-এ ছাপা হয়েছে আমার প্রথম গল্প ‘বন্ধু’। ডাকে পাঠিয়েছিলাম। লেখালেখির জগতের কাউকেই চিনি না। ’৭৪-এর পহেলা বৈশাখ ‘চাঁদের হাট’-এর লেখকদের নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘পূর্বদেশ’ অফিসে। জেনে আমিও গেছি। দোতলার একটা রুমে আয়োজন। হাতে লেখা পোস্টার-ফেস্টুনে সাজানো হয়েছে রুমটি। আমার বয়সি অনেকেই ব্যস্তভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছে। তাদের মাথার ওপরে আছেন লম্বা মতন এক ভদ্রলোক। এ মানুষটি রফিকুল হক ‘দাদুভাই’। আমাদের একত্র করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর। আমি কাউকে চিনি না। বোকার মতো ঢুকেছি অনুষ্ঠানে। ছোটখাটো একটি ছেলে এসে নাম জিজ্ঞেস করল। বলার পর হাসিমুখে আমার হাত ধরল। ও তুমি ‘বন্ধু’। অর্থাৎ আমার গল্পটির নাম তার মনে আছে। এই ছেলেটি আবদুর রহমান। প্রথমে ছড়াকার, তারপর চিত্রসাংবাদিক, তারপর বেশ কয়েকটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক। রহমানকে আমি ডাকি ‘বন্ধুটি’। ‘বন্ধুটি’ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আফজালের সঙ্গে। অত্যন্ত রোগা, লম্বা একটি ছেলে। ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে চুল। চেহারা কিছুটা রেড ইন্ডিয়ানদের মতো। ঢলঢলা পাঞ্জাবি পরে আছে। চোখে ভাবুক দৃষ্টি। মেঝেতে বসে বড় একটা সাদা কাগজে রঙিন কলমে পোস্টার লিখছিল। সেই অনুষ্ঠানে সাগরের সঙ্গেও আমার পরিচয়। দিদারুল আলম, সাইফুল আলম, ডাকনাম লিটন, গোলাম মাওলা শাহাজাদা, পরে যে নাম বদলে কবি হাসান হাফিজ হয়েছে, আলীমুজ্জান হারু, শাহানা বেগম এরকম আরও কেউ কেউ। আলী ইমামকে সেদিনই প্রথম দেখি। তখনো পরিচয় হয়নি।
সেই দিনটি থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের বন্ধুত্বের। তারপর ‘চাঁদের হাট’ সাংগঠনিক রূপ নিল। শুরু হলো আমাদের ঘনিষ্ঠ পথচলা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল ‘চাঁদের হাট’। সংগঠনের কাজে ময়মনসিংহ যাই দলবেঁধে। লঞ্চে বরিশাল যাই। অন্যদিকে সাগরের ‘খাবার দাবার’-এ আড্ডা। আরও নতুন নতুন বন্ধু যুক্ত হলো। খন্দকার আলমগীর ‘চাঁদের হাট’-এ এলো আরও পরে। সে সব দিনে পারলে আমরা ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকি। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে যে যার নিজস্ব জগৎ তৈরির চেষ্টা করছি। পাভেল রহমান যুক্ত হলো আরও পরে। সাগরের বন্ধু সিরাজও হলো বন্ধু। সিরাজ মানে শাইখ সিরাজ। রহমানের বন্ধু বাবুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। দিদারের বন্ধু স্বপন দত্ত হয়ে উঠল বন্ধু। একদিকে ‘চাঁদের হাট’, অন্যদিকে ‘খাবার দাবার’। একদিকে রফিকুল হক ‘দাদুভাই’, অন্যদিকে ফরিদুর রেজা সাগর। আমাদের তুমুল হইহল্লা, আড্ডা আর আনন্দযাপন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে যে যার ক্ষেত্রে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
আফজাল বহু ক্ষেত্রে কাজ করতে শুরু করেছে। সাগর লিখছে, টেলিভিশনে ছুটছে, ‘খাবার দাবার’-এ ব্যবসা করছে। সঙ্গে আছে শাইখ সিরাজ। ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে তখনই বিখ্যাত পাভেল রহমান। সে ছুটছে ক্যামেরা নিয়ে। রহমান লিখছে আর সাইফুল আলমকে নিয়ে ‘চাঁদের হাট’-এর পাতা সামলাচ্ছে। সেই পাতায় ছবি আঁকার কাজ করছে আফজাল। অন্যদিকে আমাদের পড়াশোনাও চলছে। অর্থাৎ যে যার ক্ষেত্রে সে আমাদের ফুটে ওঠার কাল। দলের মধ্যে থেকেও আফজালের সঙ্গে আমার অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। তখন আফজাল নিউমার্কেটের পশ্চিম দিককার চারুকলার হলে থাকে। সেখানে গিয়েছি। আফজাল একটা প্রিন্টের লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এলো। তারপর যেখানে যেখানে সে থেকেছে, সম্ভবত মাসের অর্ধেকটা সময় আমি ওর সঙ্গে থাকতাম। আর নানা রকমের পরিকল্পনা আমাদের। বিকশিত হওয়ার জন্য দুজনেরই বুকের ভিতরটা টগবগ টগবগ করে ফুটছে।
‘অবজারভার ভবন’ থেকে বেরিয়ে উল্টো দিককার গলির ভিতর বাদশার হোটেলে আমরা খেতে যেতাম। মালিক বাদশা ভাই। মোটা মতো কালো একজন অমায়িক হাসি মুখের মানুষ। আমাদের দলটিকে খুব ভালোবাসতেন। সেগুনবাগিচার ভিতর দিককার একটা ভাতের হোটেলেও মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। দিদার নিয়ে যেত ঢাকা কলেজের উল্টো দিককার একটা রেস্টুরেন্টে। ‘চাঁদের হাট’-এর ট্যুর শেষ করে এসে এমন মায়াবী একেকটা লেখা লিখত আমার বন্ধুরা, পড়ে আমি মুগ্ধ হতাম। দিন যায়।
আফজাল একটা নব্বই সিসির মোটরবাইক কিনেছে। তার পিছনে চড়ে ঘুরে বেড়াই। একদিকে ওর ‘চারুকলা’, একদিকে ‘ঢাকা থিয়েটার’, একদিকে ‘বিটিভি’, একদিকে ‘চাঁদের হাট’ আর ‘খাবার দাবার’। সে এক উন্মাতাল দিন। ধীরে ধীরে আফজাল সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। এক ফাঁকে ‘অ্যাডবেস্ট বিজ্ঞাপন সংস্থা’ করল বাচ্চুভাইদের সঙ্গে। আবার সেখান থেকে বেরিয়েও এলো। এরকম দিন কাটছে। অন্যদিকে আফজাল আর সুবর্ণা জুটি তখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে বসবাস এই দুজনের।
গেন্ডারিয়া লোহারপুলের কাছে ওয়াহিদ কোম্পানির বাড়ি। ওয়াহিদ সাহেব হচ্ছেন গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের বাবা। বাড়িটি ‘লঞ্চ কোম্পানির বাড়ি’ নামে পরিচিত। তিনতলা বিশাল দালানের দক্ষিণ দিকে দোতলা একটি কাঠের ঘর। সেই দোতলায় থাকতাম আমরা। ছোট্ট চিপা একটা রুম ছিল আমার নিজস্ব। দুই-এক রাত সেই রুমে গিয়ে আফজাল আমার সঙ্গে থেকেছে। আমার টানে হঠাৎ রাত ১০টার দিকে গিয়ে হাজির হয়েছে। তারপর বাসা বদল করে আমরা চলে এসেছিলাম সাধনা ঔষধালয়ের ওখানকার একটি ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাটে এক বিকালে আফজাল-সুবর্ণা এলো। ওদের দেখে গেন্ডারিয়ায় সাড়া পড়ে গেল। এই দুজনের কারণে গেন্ডারিয়াতে আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। আরেকবার ওদের নিয়ে দলবেঁধে চাংপাইতে খেতে গেলাম সবাই। খাওয়ার পর রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, গাড়ি-ঘোড়া থেমে গেল। লোকজন যে যেখানে আছে, দাঁড়িয়ে গেল। মাঝখান দিয়ে আমরা রাজার মতো হেঁটে যাচ্ছি। এরকম কত স্মৃতি!
আফজালের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাইগ্রেনের ওষুধ সে খেত না। কপালের দুই পাশে ইন্ডিয়ান কিংবা চায়নিজ বাম লাগাত। বামের অদ্ভুত গন্ধে ভরে থাকত ওর রুম। কষ্ট সহ্য করার তীব্র ক্ষমতা তার। মাইগ্রেনের ব্যথায় চোখ দুটো ঘোলা হয়ে যেত। আর ছিল অদ্ভুত একটা জ্বর। বছরে একবার হতো। একশো তিন-চার ডিগ্রি। দিন সাতেক খুব ভোগাত। জ্বরের ঘোরে চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। আমরা তার পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এ ঘটনা দু’তিনবার ঘটেছে গ্রিন রোডের ফ্ল্যাটে। রুমের এক পাশে ফোমের বিছানা। সেখানে শুয়ে আছে সে। আমরা কয়েক বন্ধু শুয়েছি ফ্লোরে। আফজাল হচ্ছে ঘুমের মাস্টার। তীব্র গরমকালেও প্রিয় কাঁথাটিতে আগাপাসতলা ঢেকে শোবে। শোয়ার মিনিট খানেকের মধ্যে গভীর ঘুম। অসুখ-বিসুখে পড়তে তেমন দেখিনি। ষাটের কাছাকাছি এসে হৃদয়ে সমস্যা হলো। প্রথমবার ট্রিটমেন্ট করিয়ে এলো ব্যাংককে গিয়ে। এক-দুই বছর পর আবার গেল। রিং পরাবার সময় সেবার একটু জটিলতা দেখা দিল। এক সন্ধ্যায় ফোন করেছি। ব্যাংককের হাসপাতালে শুয়ে ফোন ধরল। সেই প্রথম আফজালের একটু কাতরকণ্ঠ শুনলাম। ‘এবার একটু কষ্ট হয়েছে রে।’ শুনে বুকটা হু হু করে উঠল। ঘরের ভিতর পায়চারি করতে লাগলাম। এক সময় ছোট মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে বাবা? কাঁদছ কেন?’ নিজের অজান্তে কখন কাঁদতে শুরু করেছিলাম, টের পাইনি।
শেষবারের মতো আরেফীনের মেয়ে ছোঁয়ার বিয়েতে দেশে এসেছিল সৌরভ। তার আগেরবার যখন এলো, আমরা একটা মাইক্রোবাস নিয়ে কক্সবাজার রওনা দিলাম। রাতেরবেলা শ্যামল মিত্রের গান শুনতে শুনতে যাত্রা। তিন-চারটা দিন কোথা দিয়ে যে কেটে গেল! সেবার প্রথম লক্ষ্য করলাম, খুনসুটি, একে খোঁচানো, ওকে নিয়ে ঠাট্টা করা, নীললোহিতের দল, সবই ঠিক আছে, শুধু আমাদের লাগেজে যুক্ত হয়েছে ছোট একটি ওষুধের ব্যাগ। শরীরে ভাঙন লেগেছে।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে খুবই ছেলেমানুষি একটি কারণে ভীষণই মনোমালিন্য হয়ে গেল আফজালের সঙ্গে। দুজনের কেউ কারও মুখ দেখি না। দেখা হতে পারে এমন জায়গাগুলো এড়িয়ে চলি। দলের অন্য বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ কমে গেল। গেন্ডারিয়ায় ছোট ছোট দুটো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকি। একটায় থাকা, অন্যটায় লেখালেখি আর বইপত্র। ১০টি বছর কেটে গেল। প্যাকেজ নাটকের যুগ শুরু হলো। আফজাল তখন ‘মাত্রা’র পাশাপাশি ‘ইনফ্রেম’ করেছে। ক্যামেরা, এডিটিং প্যানেল ইত্যাদির ব্যবসা। প্যাকেজ নির্মাতাদের একটি সংগঠন হয়েছে। ‘মাত্রা’ তখন পুরানা পল্টনের অন্য একটি বিল্ডিংয়ে। ‘মাত্রা’র পাশের খালি ফ্ল্যাটটিতে প্যাকেজ নির্মাতাদের মিটিং ডাকা হয়েছে। আমি তো ওদিকটাতে যাই-ই না। সেদিন গিয়েছি। সকাল ১১টা বাজে। মিটিংয়ে আফজাল আরেফীনও আছে। সংগঠনের বিভিন্ন পদে বিভিন্ন জনের নাম প্রস্তাব করা হচ্ছে। বড় একটা পদে এসে আটকে গেল সবাই। আফজালের সঙ্গে আমার ১০ বছর কথা নেই, মুখ চাওয়া-চাওয়ি নেই। সে সব আমার মনেই রইল না। আমি ওর নাম প্রস্তাব করলাম। সে চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল। আরেফীন আর আলমও অবাক। আফজাল সাধারণত কোনো সংগঠনের পদে থাকে না। আমার প্রস্তাব শুনে বলল, ‘আমি না, আরেফীন থাকুক।’
মিটিং শেষ। চা খাওয়া হচ্ছে। আফজাল আরেফীন ঢুকে গেছে ‘মাত্রা’য়। কিছুক্ষণ পর আরেফীন এসে আমার হাত ধরল। ‘আয়।’ ১০ বছর ‘মাত্রা’য় ঢুকিনি। আরেফীন হাত ধরে নিয়ে গেল। সোজা আফজালের রুম। আফজাল উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। ‘আয় বোস।’ মুহূর্তে আমরা পেরিয়ে গেলাম ১০টি বছর। পুরোটা দিন ‘মাত্রা’য় আড্ডা দিলাম। দিদারও এলো এক সময়। রাতের বেলায় আফজাল আমাকে গেন্ডারিয়ার বাসায় পৌঁছে দেবেই। আমি বারবারই মানা করছি। সে যাবেই। আমার মানা করার কারণ হচ্ছে, আমার ফ্ল্যাটের ওদিককার চিপাগলিতে গাড়ি রাখার জায়গা নেই। তারপরও আফজাল যাবেই। কিছু করার নেই। আফজাল, আরেফীন, দিদার আর আমি বোধহয় আলমও ছিল, এক গাড়িতে গাদাগাদি করে এলাম। স্বামীর সঙ্গে তার পুরনো বন্ধুদের দেখে স্ত্রীটি অবাক। ফ্যাল ফ্যাল করে আফজালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমাদের বন্ধুত্ব এরকমই।
‘বিচিত্রা’ ও ‘আনন্দ বিচিত্রা’র সম্পাদক ছিলেন আমাদের প্রিয় অগ্রজ শাহাদত চৌধুরী। তাঁর অভিনবত্বের তুলনা ছিল না। একবার ‘আনন্দ বিচিত্রা’য় নারী পাঠকের একটা জরিপ করিয়েছিলেন। ‘কেমন পুরুষ পছন্দ’। নব্বই শতাংশ ভোট পেয়েছিল আফজাল। তার অনেক পেছনে ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। আফজাল সিনেমার পোকা। সব দেশের সিনেমাই দেখে। ভারতীয় বাংলা সিনেমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। টিভি ধারাবাহিক, শর্টফিল্ম, বিজ্ঞাপন চিত্র সব কিছুতে সমান নজর। ‘টকিজ’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিল। ধানমন্ডির সেই অফিসের একটি রুম ভরা ছিল সিনেমার ভিডিও ক্যাসেট, সিডি ইত্যাদিতে। পুরনো স্বভাব নিয়ে সিডির দোকানগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াত। আধুনিক নাটক নির্মাণেও আফজাল অগ্রগণ্য। ফরিদুর রেজা সাগরের ‘ছোটকাকু’ নির্মাণ করে প্রতি ঈদে। ‘ছোটকাকু’ চরিত্রে অভিনয়ও করে। ‘ওটিটি’তে অসামান্য সব চরিত্রে অভিনয় করছে। সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজ করছে। কাজে মগ্ন মানুষ বলতে যা বোঝায়, সে তাই।
১০ বছর বিরহকাল কাটানোর পর আমরা যখন আবার মিলিত হলাম, কথায় কথায় আফজাল জানল, আমার মেয়েরা ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ে, এ জন্য স্কুলের কাছে আমি ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। সেখানে ওঠা হয়নি। মেয়েদের স্কুলে দিয়ে সেই ফ্ল্যাটে বসে লেখালেখি করি। ছুটি হলে ওদের নিয়ে গেন্ডারিয়ায় ফিরে যাই। শুনে আফজাল আর আরেফীন ফ্ল্যাটে একদিন গেল। কয়েক মাস ধরে অতি যত্নে ফ্ল্যাটের ইন্টেরিয়র করে দিল আফজাল। তবে ওর যা স্বভাব, একটা দিকের কাজ হয়তো করে ফেলেছে, দেখতে গিয়ে পছন্দ হলো না, মিস্ত্রিকে ভেঙে ফেলতে বলল। আমার যে টাকা-পয়সা নেই, বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য নেই, ওসব সে ভাবলই না। শেষ পর্যন্ত সুন্দর ইন্টেরিয়র হলো।
নিজের শহর বগুড়ায় সাগর একটা পুরস্কার পেয়েছে। আমাদের সবাইকে নিয়ে গিয়েছে সেই পুরস্কার আনতে। ফেরার দিন গাড়িতে আমি আর আফজাল দুই পাশে, মাঝখানে রাবেয়া খাতুন। খালাম্মা তাঁর জীবনের স্ট্রাগলের কথা বলছিলেন। আমিও আমার কথা বলছিলাম। আফজাল অবাক হয়ে শুনছিল। ‘চ্যানেল আই’য়ের প্রোগ্রাম করতে কক্সবাজারে গেছি। ‘শৈবাল’-এ উঠেছি সবাই। এক সকালে শৈবালের পিছন দিককার বাগানে রাবেয়া খালাকে মাঝখানে রেখে আফজাল আর আমি হাঁটছি। খালাম্মা আমার হাত ধরে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক দেখে আফজাল সিদ্ধান্ত নিল, আমাদের দুজনকে নিয়ে একটা বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করবে। সেই কাজটা আর হয়নি। রাবেয়া খালা চলে গেলেন।
বন্ধুদের মধ্যে আমি সবার আগে বিয়ে করলাম। ’৮২ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন ‘দোয়েল’ আছে। বিয়ে-বৌভাত দুটোতেই আফজালের নেতৃত্বে বন্ধুরা আছে। পাভেল অবিরাম ছবি তুলছে। বৌভাতের আয়োজন হলো ‘দোয়েল’-এর নিচতলায় শরফুদ্দিন ভাইয়ের ‘ইয়াংস চায়নিজ রেস্টুরেন্ট’-এ। শরফুদ্দিন ভাই, সজলদা, মাকসু খুব যত্নে রান্নাবান্না ও অন্যান্য আয়োজন সামলেছিল। সেই সন্ধ্যায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আফজাল-সুবর্ণা অভিনীত আমার ‘মায়াকানন’ নাটকটি বিটিভিতে পুনঃপ্রচার হলো। মনে হলো ওটা আমার বিয়ের সবচেতে বড় উপহার। আফজাল কাউকে কিছু জানতে দেয়নি। নাটকটি পুনঃপ্রচারের ব্যবস্থা করেছিল। ‘বৌভাতের দিনে বন্ধুকে উপহার’। আমার বড় মেয়েটির বিয়ে। আরেফীনকে বললাম, ‘তুই উকিল বাপ হ। আর নয়তো সাগরকে বল।’ আফজালের নাম ভাবার সাহসই হয়নি। ধারণা ছিল সে এসবের মধ্যে থাকবে না। আরেফীন বলল, ‘আফজালকে বলে দেখি।’ আফজাল নির্দ্বিধায় রাজি হলো। শুধু আমার বড় মেয়েটিরই না, ছোটটিরও উকিল বাপ সে। আরেফীন, আলম, দিদার প্রত্যেকের মেয়ের উকিল বাপ। আফজালের দুই ছেলে। মেয়ে নেই। এখন প্রত্যেক বন্ধুর মেয়েই তার মেয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে নিজ হাতে অসামান্য সব বিয়ের কার্ড তৈরি করল প্রতিটি মেয়ের বিয়েতে।
আফজাল এরকমই।
চোখের পলকে যেন জীবনের অনেকটা পথ আমরা হেঁটে এলাম। ৫০ বছর আগে যে বন্ধুত্বের শুরু, পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, এই তো সেদিনকার কথা! অথচ সময়টা কী দুর্বার গতিতে কেটে গেছে। আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই বয়সের ছাপ। কিন্তু মনের ভিতরটা এখনো নীললোহিত। সেখানে বয়স কোনো ছায়া ফেলতে পারেনি। মাঝে মাঝে এ ওর ফ্ল্যাটে একত্রিত হই আমরা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। আফজাল অনেক উঁচু। ওর মাথাটা সবার উপরে জেগে থাকে। মেধা মনন আর প্রতিভায় আফজাল আসলেই অনেক উঁচু। ওর উচ্চতা ছোঁয়ার সাধ্য আমাদের কারও নেই। আমরা শুধু বলতে পারি, ‘বন্ধু, রহো রহো সাথে।’
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ