শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো মসজিদ

তানিয়া তুষ্টি

বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো মসজিদ

যুগে যুগে ইসলামের আলো ছড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে পবিত্র ধর্মালয় মসজিদ। মুসলিম বুজুর্গ ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছেন এসব মসজিদ নির্মাণে। মসজিদের মাধ্যমে সব মানুষকে ডাকা হয়েছে শান্তির ধর্মের ছায়াতলে। এসব মসজিদের মাধ্যমে প্রসার ঘটেছে ইসলাম ধর্মের। ইসলামের ডাকে বহু মানুষ সাড়া দিয়েছে। বদলে গেছে সেখানকার সামাজিক, ধর্মীয় ও নীতি-নৈতিকতার চালচিত্র। নানারকম ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে সে সব মসজিদ। আজকের রকমারি আয়োজনে থাকছে বিশ্বের পুরনো মসজিদ সম্পর্কে বিস্তারিত

 

মসজিদ আল-হারাম সৌদি আরব

মহানবীর (সা.) মক্কা জয়ের পর থেকে ৬৯২ সাল

পবিত্র কাবা শরিফকে ঘিরে অবস্থিত মসজিদ আল-হারাম বা মসজিদে হারাম। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী সৌদি আরবের মক্কা শহরের এই মসজিদটি সবচেয়ে পবিত্র স্থান। মসজিদের যে কোনো স্থান থেকে নামাজ পড়ার সময় মুসল্লিরা কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ান। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) দুজন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন। শুরুর দিকে মসজিদ আল হারামসহ কাবাচত্বর একটি খোলা স্থান ছিল। সংস্কারে ছাদসহ দেয়াল দিয়ে এলাকাটি ঘিরে দেওয়া হয়। অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মসজিদের পুরনো কাঠের স্তম্ভগুলোর বদলে মার্বেলের স্তম্ভ দেওয়া হয়। তখন নামাজের স্থান বৃদ্ধিসহ মিনার যুক্ত করা হয়। প্রতি বছর হাজীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদে আরও সংস্কার করা হয়। ১৫৭০ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে মসজিদ পুনর্র্নির্মাণের আদেশ দেন। এই সময় সমতল ছাদগুলোর বদলে ক্যালিওগ্রাফি সংবলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এগুলো বর্তমান মসজিদের সবচেয়ে পুরনো প্রত্ননিদর্শন। ভিতরে ও বাইরে নামাজের স্থান মিলে মসজিদের বর্তমান কাঠামো প্রায় ৮৮.২ একর। মসজিদটি সার্বক্ষণিক খোলা থাকে। হজের সময় এখানে উপস্থিত হওয়া মানুষের জমায়েত পৃথিবীর বৃহত্তম মানব সমাবেশের অন্যতম। এখানে একসঙ্গে ১০ লাখ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে। হজের সময় প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ এখানে উপস্থিত হয়। হজ ও উমরাহর জন্যও মসজিদ আল হারামে যেতে হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের পর কাবায় পৌত্তলিকতার চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় মসজিদ আল-হারামের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ৬৯২ সালে মসজিদে প্রথম বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। ২০০৭ সালে মসজিদ আল-হারামের চতুর্থ সম্প্রসারণ কাজ শুরু হয়, যা ২০২০ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

কুবা মসজিদ

সৌদি আরব (৬২২ সাল)

মসজিদে কুবা বা কুবা মসজিদ সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। এটি ইসলামের প্রথম মসজিদ। ‘কুবা’ একটি কূপের নাম। এই কূপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কুবা মহল্লা। নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরতের প্রথম দিন কুবায় অবস্থানকালে এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, মহানবী (সা.) যখন এর ভিত্তি স্থাপন করেন তখন কেবলার দিকের প্রথম পাথরটি নিজ হাতে স্থাপন করেন। মসজিদটি শুরু থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা সংস্কার হয়। সবশেষ ১৯৮৬ সালে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। পুরো মসজিদ নির্মাণে এক ধরনের সাদা পাথর ব্যবহার করা হয়। এতে চারটি উঁচু মিনার, ছাদে একটি বড় গম্বুজ এবং পাঁচটি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ রয়েছে। এ ছাড়া ছাদের অন্য অংশে রয়েছে গম্বুজের মতো ছোট ছোট অনেক অবয়ব। রয়েছে জমজম পানির ব্যবস্থা। মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসেন। এখানে নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের ব্যবস্থা।

 

উকবা মসজিদ

তিউনিশিয়া (৬৭০ সাল)

ঐতিহাসিক একটি মসজিদ ‘উকবা মসজিদ’। এই মসজিদ তিউনিশিয়ার কাইরুয়ান নগরীতে অবস্থিত। এ কারণে বিশ্বের কাছে মসজিদটি কাইরুয়ান জামে মসজিদ নামেও বহুল পরিচিত। ৬৭০ সালে আরব সেনানায়ক উকবা ইবনে নাফি কাইরুয়ান নগরীতে এটি নির্মাণ করেন। পরে বহুবার এর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়। এর            বিস্তৃতি প্রায় ৯ হাজার বর্গমিটার। মসজিদে পাঁচটি গম্বুজ ও নয়টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে ইট ও পাথর দিয়ে। পরবর্তীকালে এটি মাগরেবে অবস্থিত অন্যান্য মসজিদের মডেল হিসেবে গণ্য হয়। প্রাচীনতম এই মসজিদটি বিশ্বের খ্যাতিমান কয়েকটি মসজিদের মধ্যে অন্যতম। উকবা মসজিদ উত্তর আফ্রিকার চিত্তাকর্ষক ও বৃহৎ স্থাপনার একটি। সমসাময়িক প-িতরা এই মসজিদকে ইসলামিক চিন্তাধারা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করতেন।

 

আল-আকসা

জেরুজালেম (হজরত সুলাইমানের আমলে)

ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা। এই মসজিদ প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। পুরো স্থানটি ‘হারাম আল শরিফ’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও স্থানটি ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে পরিচত। হাদিস অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। মুসলিম প-িতদের মতে, সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটিই নবী সুলাইমান (আ.) তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, নির্মাণের পর থেকে এটি ঈসা (আ.)সহ অনেক নবীর আল্লাহর উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। খলিফা উমর এই পবিত্র স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্র্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ সালে তার ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়।

 

চেরামান জামে মসজিদ

কেরালা, ভারত (৬২৯ সাল)

ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর অঞ্চলের চেরামান জামে মসজিদ। মসজিদের সামনে স্থাপিত শিলালিপি অনুযায়ী ৬২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানীয় মুসলমানরা এটিকে ‘চেরামান জুমা মসজিদ’ও বলে থাকে। একাদশ শতাব্দীতে মসজিদটির সংস্কার ও পুনর্র্নির্মাণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে মুসল্লি বৃদ্ধির ফলে ১৯৭৪, ১৯৯৪ ও ২০০১ সালে মসজিদের সামনের অংশ ভেঙে আয়তন সম্প্রসারিত করা হয়। প্রাচীন মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশ, মিহরাব ও মিনার এখনো আগের মতো অক্ষত রয়েছে। মসজিদের বহির্ভাগ কংক্রিট দিয়ে তৈরি হয়। অজু করার জন্য ব্যবহার হয় পুকুর। মসজিদের পাশঘেঁষা খালি জায়গায় দুটি কবর বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, একটি হাবিব ইবনে মালিকের, অন্যটি তাঁর স্ত্রী মুহতারামা হুমায়রার। রমজান মাসে বিপুলসংখ্যক মুসল্লি ইবাদত-বন্দেগির উদ্দেশ্যে এ মসজিদে আগমন করে থাকেন।

 

আল আজহার মসজিদ

কায়রো, মিসর (৯৭২ সাল)

ফাতেমীয় খলিফা আল-মুইজ লিদিনাল্লাহর তত্ত্বাবধানে আল আজহার মসজিদের নির্মাণ কাজ চলে ৯৭০-৭২ সাল পর্যন্ত। এটি মিসরের কায়রোতে অবস্থিত প্রথম মসজিদ। ৯৮৯ সালে এখানে ৩৫ জন আলেম নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর মসজিদটি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে। নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাদানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ শরিয়া শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসার অংশ হিসেবে মসজিদের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৬১ সালে এটি জাতীয়করণ এবং স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষিত হয়।

 

মসজিদ আল-কুফা

নাজাফ, ইরাক (৬৭০ সাল)

সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদ আল-আজম বিশ্বের পুরনো মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ইরাকের নাজাফ প্রদেশের কুফা এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় মসজিদ আল-কুফা নামে সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমানে ভবনটির আয়তন প্রায় ১১ হাজার মিটার। নয় কক্ষবিশিষ্ট এই মসজিদে চারটি মিনার এবং পাঁচটি গেট রয়েছে। মসজিদটি সাজানো হয়েছে সোনা, রুপা এবং বহু মূল্যবান পাথর হীরা, রুবি দিয়ে। মসজিদের ভিতরে সোনার অক্ষরে কোরআনের আয়াতের চারুলিপি রয়েছে। পুরো মসজিদে ব্যবহৃত মার্বেল এবং টাইলস গ্রিস থেকে আমদানি করা হয়েছে। এই টাইলসগুলো মক্কার কাবাতুল্লাহতেও ব্যবহার করতে দেখা যায়।

 

 

গ্রেট মস্ক অব আলেপ্পো

সিরিয়া (৭১৫ সাল)

মধ্যযুগীয় সিরীয় প্রতীক ‘গ্রেট মস্ক অব আলেপ্পো’। এর নির্মাণ শুরু হয় অষ্টম শতকের শুরুর দিকে। মসজিদটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ৭১৫ সালে। একাদশ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদে অনেক কিছুর সংযোজন ঘটে। কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও ভূমিকম্প সহ্য করে এলেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ২০১৩ সালে মসজিদটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে আশার কথা এই যে, কয়েক শত বছরের পুরনো মসজিদটির মিনারগুলো শুধু ধ্বংস হয়েছে। মসজিদের বাড়তি শোভাবর্ধনকারী এই মিনারগুলো নির্মাণ হয়েছিল ১০৯০ সালে। কবে নাগাদ এটি সংস্কার করা হবে তা অজানা।

 

হুয়াইশেং মসজিদ

চীন (৬২৭ সাল)

চীনের গুয়াংজোর প্রধান মসজিদ হুয়াইশেং। তাং রাজ বংশের রাজত্বকালে ৬২৭ সালে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা হজরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি ‘লাইটহাউস বা বাতিঘর মসজিদ’ নামেও পরিচিত। হুয়াইশেং শব্দটির অর্থ হলো ‘জ্ঞানী লোককে স্মরণ’। বিশ্বনবী (সা.)-কে স্মরণ করে মসজিদটির নামকরণ করা হয় হুয়াইশেং মসজিদ। ৮১৩ বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি এখন পর্যন্ত অনেকবার সংস্করণ করা হয়েছে। তবে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে চীনের ঐতিহ্য ও স্থাপত্যশৈলী। মসজিদটির ভিতরের অংশটি অত্যন্ত চমৎকার কারুকার্য ও আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে সৌন্দর্যমন্ডিত ও আকর্ষণীয়। এর রয়েছে ১১৮ ফুট উচ্চতার সরু মিনার, যেটিকে মসজিদের আলোক বুরুজও বলা হয়। বুরুজের ভিতরে রয়েছে সিঁড়িপথ। একসময় এ আলোক বুরুজটিকে ঝুজিয়াং নদীতে চলাচলকারী  নৌকার জন্য আলোকস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার হতো।

সর্বশেষ খবর