বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ লইয়া ছবি হয় না কেন : আলমগীর কবিরের উত্তর

সলিমুল্লাহ খান

মুক্তিযুদ্ধ লইয়া ছবি হয় না কেন : আলমগীর কবিরের উত্তর

চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির

চলচ্চিত্রকার পরিচয়ে দেখা দিবার আগে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) অনেক দিন ধরিয়া চিত্র সমালোচনা লিখিতেন। দেশ স্বাধীন হইবার আগে তিনি পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প বিষয়ে একটি ইংরেজি বই লিখিয়াছিলেন। দশ বছর পর—১৯৭৯ নাগাদ—সেই বইটির নতুন নামে নতুন সংস্করণও একটি প্রকাশিত হইয়াছিল। আলমগীর কবির কোনদিন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না, রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তিনি ছিলেন যাহাকে বলে ‘মাওবাদী’ বা চিনাপন্থি সেই ঘরানার। তিনি তারপরও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়াছিলেন। আশ্রয়ের সন্ধানে গিয়াছিলেন পাশের দেশ ভারতে। এই লইয়া তাহার কোনো ‘ব্যক্তিগত হীনমন্যতা’ ছিল না।

তিনি যুদ্ধকালীন সরকারের মাত্র প্রধান সংবাদদাতার পদ অলঙ্কৃত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি অনুষ্ঠানটি তিনিই গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে পঠিত তাহার নিজের লেখা একাশিটি নিবন্ধ তিনি নিজেই জীবদ্দশায় প্রকাশ করিয়া গিয়াছিলেন। সম্প্রতি সেই নিবন্ধ সংকলনের দ্বিতীয় মুদ্রণ হইয়াছে। প্রথম সংস্করণ বড় অযত্নে বাহির হইয়াছিল, বইটির সূচিপত্র ছিল না। দ্বিতীয় সংস্করণে সূচিপত্র থাকিলেও কোনো নির্দেশিকা যোগ হয় নাই। আর কবিরের জীবনী বলিয়া যাহা যোগ হইয়াছে তাহাও মজার মজার যত ভুলে ভরা।

তারপরও একটি সুখবর আছে। আলমগীর কবিরকে যাহারা কখনও সশরীরে দেখেন নাই, কিংবা দেখিলেও যাহাদের মনে থাকিবার কথা নহে তেমন ছয়-সাতজন নবীন আলমগীর কবির ভক্ত তাহার এই ইংরেজি বহিটির বাংলা তর্জমা করিয়াছেন। আশা করি, বেশি বিলম্ব ঘটিবার আগেই তর্জমাটি আত্মপ্রকাশ করিবে। আমার সৌভাগ্য হইয়াছে, প্রকাশনার আগেই বহিটির বেশির ভাগ পাতা পড়িতে পারিয়াছি। তর্জমাকারগণের প্রশ্রয় পাইয়া আমাকে এই বইয়ের ভূমিকামত একটা লেখাও লিখিতে হইয়াছে। বহির নাম আপাতত স্থির হইয়াছে ‘১৯৭১ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

আলমগীর কবির চলচ্চিত্র বিষয়ে এত লেখা লিখিয়াছিলেন কিন্তু সেইগুলি একত্র করিয়া এতদিন কোন বহি প্রকাশ করা হয় নাই—এ কথা জানিতে পারিলাম মাত্র সেদিন। ‘১৯৭১ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইটি যাহারা তর্জমা করিয়াছেন তাহারাই আবারও আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র বিষয়ক নিবন্ধের একটি বড় সংগ্রহ সম্পাদনা করিয়া আমাকে অবাক করিয়াছেন। গত মাসখানেক ধরিয়া এই সকল নিবন্ধ পড়িতেছি আর ভাবিতেছি, সত্যি কি বিচিত্র, কি অকৃতজ্ঞ আমার দেশ! ভাবিতেছি আমার দেশবাসী আরও অবাক হইবেন যখন তাহারা জানিবেন কি অমূল্য সম্পদ এতদিন আমাদের চোখের আড়ালে ছিল।

আমাদের ছয় অতি নবীন সম্পাদক তাহাদের আলমগীর কবির সংগ্রহের নাম রাখিয়াছেন ‘চলচ্চিত্র ব্যবসায়’। এই ব্যবসায়ে প্রায় তিরিশটি নিবন্ধ আছে, দেখিতে পাইলাম। আলমগীর কবিরের সকল লেখাতেই জানিবার কথা আছে প্রচুর। আর ভাবিবার কথা আছে ঢের। আজ এই নিবন্ধে আমি নমুনাস্বরূপ তাহার একটি মাত্র নিবন্ধ আমলে লইয়া সন্তুষ্ট থাকিব। কারণ আমার এই মুহূর্তে সময়ের—আর বলাবাহুল্য—জায়গার বড়ই অভাব। শুদ্ধ বলিয়া রাখি, আলমগীর কবিরের প্রতিটি নিবন্ধই আমাদের শ্রদ্ধেয় সমালোচনার যোগ্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লইয়া যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের পর পর এদেশে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হইয়াছিল। কিন্তু একসময় মুক্তিযুদ্ধ লইয়া ছবি বানানো বন্ধ হইয়া যায়। ‘আমাদের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুতে এখন মুক্তিসংগ্রাম আগের মত স্থান পাচ্ছে না কেন’—এই রকম একটা প্রশ্ন সেদিন পেশ করিয়াছিলেন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’। ১৯৮১ সালের ২৭ মার্চ তারিখের কথা। তখনও জেনারেল জিয়াউর রহমান বাঁচিয়া ছিলেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে আলমগীর কবির সেদিন বেশ কিছু কড়া কথা প্রাণখোলা বলিয়াছিলেন। আমার আজিকার নিবন্ধের পুঁজি সেই দিনের উত্তর হইতেই সংগ্রহ করিয়াছি।

আলমগীর কবির বলিতেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পর মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করিয়া আট হইতে দশটি ছবি বানানো হইয়াছিল। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, সেই সকল ছবির মধ্যে অনেকগুলিতেই মুক্তিযুদ্ধকে সার্থকভাবে উপস্থাপন করা হয় নাই। পরিবর্তে যাহা করা হইয়াছিল তাহা আলমগীর কবিরের অনুমোদন মোটেও লাভ করে নাই। তিনি বলিতেছিলেন, এইসব ছবির মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করার চাইতে সে সময়কার একটি দুর্ঘটনা—আমাদের মা-বোনদের শ্লীলতাহানির বিষয়টিকে বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করা হয়।’ ফলে—অন্যান্যের মধ্যে—এসব ছবি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করিতেও ব্যর্থ হয়।

চিত্র নির্মাতাদের এই ব্যর্থতার কারণও অনুসন্ধান করিয়াছিলেন তিনি। তাহার মতে, ‘যেসব নির্মাতা বাণিজ্যিক ছবি করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের প্রায় সকলেরই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ধারণা ছিল ভাসাভাসা। তারা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে দেখাতে পারেননি। কিংবা তাদের দেখার ক্ষমতা ছিল না। আর এই অক্ষমতা নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাপারকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।’

তাহাকে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তরে ‘চিত্রালী’ পত্রিকাকে আলমগীর কবির মাত্র তিনটি উদাহরণেই সামাল দিয়াছিলেন। অন্যান্য নিবন্ধে তিনি আরো উদাহরণের যোগান দিতে দ্বিধা করেন নাই। ‘চিত্রালী’র প্রশ্নের উত্তরে তাহার প্রথম দুইটি উদাহরণ ছিল এই রকম : ‘যেমন ‘বাঘা বাঙালী’, যেমন মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’। শেষোক্ত ছবিটিতে তো পরিচালক একজন ধর্ষিতা রমণীর রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে ফেলেন! এমনকি সুভাষ দত্ত যে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ বানান সেখানেও তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একটি অপ্রধান সমস্যা—বীরাঙ্গনার সন্তানকেই প্রধান করে তুলে ধরেন।’

আলমগীর কবির নিজেকেও রেহাই দেন নাই এই ক্ষমাহীন বিশ্লেষণের হাত হইতে। এই মহান উদাহরণকে আমরা তাহার শৈল্পিক ও বৈজ্ঞানিক সততার পরম প্রমাণ জ্ঞানে গ্রহণ না করি তো বড় অন্যায় করিব। কবির বলিয়াছিলেন, “এবার ‘ধীর বহে মেঘনা’ সম্পর্কে বলি। আমার সামনে সমস্যা ছিল—ছবি তৈরির আগে দীর্ঘদিন আমি (চিত্র) সমালোচনা লিখেছি। সে সব সমালোচনায় আমি প্রচলিত ফর্মকে আঘাত করেছি, সেই ফর্মে আমার পক্ষে ছবি তৈরি সম্ভব ছিল না। তাই ‘ধীরে বহে মেঘনা’কে আমি সিনেমাটিকে কোলাজ হিসেবে তৈরি করি। এ ছবির সমস্ত ঘটনাই ছিল বাস্তব থেকে নেয়া।”

তারপরও—আলমগীর কবির স্বীকার করিয়া বলিয়াছেন—এই ছবি মুক্তিযুদ্ধের সার্থকনামা ছবি হয় নাই। তিনি প্রথমেই আত্ম-সমালোচনা করিয়া লইয়াছিলেন, “আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল বলেই এ ছবিটি আমি বানাই। অথচ এর পরে আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কোনো ছবি বানাইনি। আমি পরিষ্কার বলতে পারি : এর কারণ ছিল আমি তখন মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক বুঝতে পারিনি। কেননা আমি জানতাম সত্য এক জিনিশ আর বাস্তব আরেক জিনিশ। আমি বুঝতে পারিনি মুক্তিযুদ্ধে কে ভিলেন এবং কে নায়ক। আমি বুঝতে পারিনি কে দালাল আর কে প্রকৃত মুক্তিকামী। তখন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমি এসব বুঝতে পারিনি।”

আলমগীর কবির সেদিন স্মরণ করিতেছিলেন, “পাঁচ বছর স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একমাত্র সোবিয়েত ইউনিয়নে দুহাজার ছবি হয়েছে। পশ্চিমে এ নিয়ে আরো অন্তত দুহাজার ছবি বানান হয়েছে।” তাহার মতে, ‘বাংলাদেশের নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে অন্তত পঞ্চাশটি ছবি তৈরি হওয়া উচিত।’ অথচ তাহার অকপট বিচারে সেদিন অর্থাৎ ১৯৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লইয়া একটাও সার্থকনামা ছবি তৈয়ার হয় নাই।

হয় যে নাই এই সত্যে সন্দেহ ছিল না আলমগীর কবিরের। কিন্তু তিনি জানিতেন, ‘সত্য এক জিনিশ’ আর ‘বাস্তব আরেক জিনিশ’। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, বাস্তব কি বস্তু? আলমগীর কবির সেই প্রশ্নের উত্তরই দিয়াছেন এই ভাষায় : ‘আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি তৈরি না হবার কারণ হচ্ছে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তারা তা হৃদয়ে অনুভব করেন না। আর যারা অনুভব করেন তারা মুক্তিযুদ্ধ সেভাবে দেখেননি।’

কবিরের এই অভিযোগ কি সত্যসত্যই সত্য? আর সত্য হলেও তাহার কতখানি পর্যন্ত সত্য? এই প্রশ্নটি আমার মনেও উঠিয়াছে বলিয়া আমি আরেকটু অনুসন্ধান করিতে চাহিলাম। দেখিলাম, কবিরের এই সাক্ষাৎকার বা নিবন্ধের গোটা পাঁচ-ছয় বছর পর—অনুমান করি ১৯৮৬ সাল নাগাদ—আমাদের মহান লেখক আহমদ ছফাও প্রায় একই কথাই বলিয়াছিলেন। আহমদ ছফার ব্যবসায় ছিল সাহিত্যের। তিনি মুখে মুখে এক সাংবাদিককে তখন বলিতেছিলেন, “অথচ মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে লেখা সাহিত্যে যুদ্ধের জীবন অনুপস্থিত। আসলে যুদ্ধের শুরু কীভাবে, কারা ভারতে গেল, কীভাবে গেল, শরণার্থী শিবিরে কারা কীভাবে ছিল, কারা শরণার্থী শিবিরে ছিল না, কারা থিয়েটার রোডে ছিল কিংবা কারা ঘরে ফিরে এলো, কারা ফিরতে পারল না—সে সব বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করে একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে মনে করে একটি কল্পনার নায়ক বানিয়ে পাক বাহিনীকে কষে গাল দিলে, দুয়েকজন ধর্ষিতা বোনের চিত্র অঙ্কন করলে, একটি যুদ্ধের সাহিত্য রচনা করা যায়—এরকম একটা অপচেষ্টায় আমাদের পেয়ে বসেছে। এই প্রবণতা সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না।”

আরো এক যুগ পরে—একেবারে ১৯৯৮ সালে পৌঁছিয়া—আহমদ ছফা আবারও (এবং অধিক দৃঢ়তার সহিত) লিখিয়াছিলেন, ‘অধিকাংশ লেখকই মুক্তিযুদ্ধের ওপর সাহিত্য রচনা করে একটা রিচুয়াল পালন করেছেন মাত্র। তার অধিক অগ্রসর হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।’ আহমদ ছফা উদাহরণও দিয়াছেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দিতে গিয়ে তারা এন্তার বীভৎস দৃশ্য রচনা করেছেন। দেখা যাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা দেদার মানুষ খুন করছে এবং নারী ধর্ষণ করে চলেছে।’

প্রশ্ন হইতেছে, ইহা সাহিত্য হইয়াছে কিনা। নাকি ইহাতে মুক্তিযুদ্ধের সার্থক পরিচয় পাওয়া গিয়াছে? আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, “পাকিস্তানি সৈন্য খুন কিংবা ধর্ষণ করেনি—ওটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। অবশ্যই তারা খুন করেছে এবং ধর্ষণও করেছে। আমাদের কথা হলো, খুন এবং ধর্ষণ মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র চিত্র নয়। এগুলো উপলক্ষ, মূল লক্ষ্য নয়। এগুলো এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যে ইতিহাসে আত্মপরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে সে জিনিশটিই উপেক্ষিত থেকে গেছে। সেই মহাবেদনা, মহাউল্লাস, মহাউত্থান—এই সকল রচনাতে পরিদৃশ্যমান নয়। খুন এবং ধর্ষণ—এগুলোর প্রতি মানবসাধারণের মনে যে ঘৃণা কাজ করে সেই জায়গাটি স্পর্শ করাই যেন এই লোকদের আসল লক্ষ্য। খুন এবং ধর্ষণ নিশ্চয়ই জঘন্য ধরনের অপরাধ। কিন্তু তার বাইরে আরো অনেক ধরনের অপরাধ রয়েছে। খুনের সংখ্যাবৃদ্ধি দেখালে কিংবা ধর্ষণের বিভীষিকাসঞ্চারী চিত্র ভোঁতাকলমে আঁকলেই যে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ চিত্র দাঁড়িয়ে যায় সেটা মোটেই সত্য নয়।”

আলমগীর কবির ১৯৮১ সালে বড় অসহায় অবস্থায় বলিয়াছিলেন, ‘মনে করুন এখন যদি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে ছবি করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরি, তাহলে সেটা দেখান সম্ভব হবে কিনা জানি না।’ সেদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়াছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন ছবি চিন্তা করা কঠিন।’ অথচ ১৯৭৭ সালে মানে চার বছর আগে তিনি আরেকটি ভয়ের কথাও উচ্চারণ করিয়াছিলেন। ভালো গল্পের বা সাহিত্যের বড়ই অভাব, বড়ই টান পড়িয়াছে দেশে। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার করণীয় কি— সে সম্বন্ধে আমার খুব একটা দ্বন্দ্ব নেই। চলচ্চিত্রে নতুন গল্প বলা আমার মতে চলচ্চিত্রকারের দায়িত্ব নয়। কারণ নতুন গল্প বা প্লট আবিষ্কার করার দায়িত্ব লেখকের। চলচ্চিত্রকারের দায়িত্ব হলো নতুন বা পুরনো যে কোনো আখ্যানের নতুন সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট বা ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করা।’ এতদিনে দেখিতেছি, কবিরের ভয়টা মোটেও অমূলক ছিল না।

তাহার একটি প্রমাণ নিচের গল্পেও পাওয়া যাইতেছে। এই মহান চলচ্চিত্রকারের অকালমৃত্যুর বয়স পদে পদে আজ প্রায় তিরিশ বছর হইতে চলিল। এদেশের ধনাঢ্য চিত্র ব্যবসায়ীদের জনৈক অবিসংবাদিত প্রতিনিধি এই এত বছর পরও এক ভয়াল সাক্ষাৎকারে পুরানা ভয়ের কথাটা আবার প্রমাণ করিয়াছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মোগল’ বলিয়া খ্যাত ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর খান সম্প্রতি নতুন করিয়া ছাড়পত্র দিয়াছেন, ‘আলমগীর কবির শিক্ষিত লোক। আমাদের দেশের সবচেয়ে নামকরা পরিচালক জহির রায়হানের তিনি সহকারী ছিলেন। সাংবাদিকও ছিলেন। এক্ষেত্রেও তার ক্যারিয়ার আছে। লন্ডন থেকে বোধ হয় ফটোগ্রাফি ও ডিরেকশনের ওপর পড়ালেখা করে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি ফিল্ম ব্যবসা বুঝতে পারেননি। তার কোনো ছবিই ব্যবসা করেনি, কিন্তু তিনি সুনাম অর্জন করেছেন।’ জাহাঙ্গীর খান অকপটে অধিক বলিয়াছেন, ‘চাষী নজরুল আমার পছন্দের পরিচালক। চাষী [নজরুল], আলমগীর কবির আর শিবলী সাদিককে ভালো ও গুণী পরিচালক বলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছি। এফ কবীর, অশোক ঘোষ আর আজিজুর রহমান আমাকে পয়সা এনে দিয়েছেন। তারা ডেডিকেটেড, দর্শকদের চাহিদা বুঝতে পারতেন, ভালো গল্প বানাতে পারতেন।’

আলমগীর কবির সম্পর্কে তাহার দুই দুইটি ছবির— ‘সূর্যকন্যা’ আর ‘সীমানা পেরিয়ে’র—প্রযোজক একেএম জাহাঙ্গীর খান অন্তিম শ্রদ্ধাটা এইভাবেই নিবেদন করিয়াছেন : “তিনি ভালো পরিচালক, যুগ যুগ ধরে—যতদিন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প থাকবে—তার ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’ [টিকে থাকবে]। ২০-৩০ বছর পরও মনে হবে [এগুলো] নতুন ছবি, নতুন আঙ্গিকের ছবি।” দুঃখের মধ্যে, জাহাঙ্গীর খানের আক্ষেপ, আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ দিয়া তিনি রংপুর হইতে মাত্র ছয় হাজার টাকা পাইয়াছিলেন। অথচ আর এক পরিচালকের সুবাদে তিনি একই রংপুর হইতেই পাইয়াছিলেন তের লাখ টাকা। এদিকে আর আর পরিচালকের কোনো কোনো ছবি হইতে তিনি আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত কামাইয়াছিলেন।

 

দোহাই

 

১.         আহমদ ছফা, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সাহিত্য : অপূর্ণতার দিক’, মানবজমিন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮।

২.         আহমদ ছফা, ‘মুক্তিযুদ্ধের ওপর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিশুদ্ধ বই আমি দেখিনি’, সচিত্র স্বদেশ,  ১৯৮৬ (আনুমানিক)।

৩.        আলমগীর কবির, চলচ্চিত্র ব্যবসায়, আরাস্তু লেনিন খান প্রমুখ (সম্পাদিত) (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, প্রকাশিতব্য)।

৪.         আলমগীর কবির, ১৯৭১ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আরাস্তু লেনিন খান প্রমুখ (অনূদিত) (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, প্রকাশিতব্য)।

৫.         একেএম জাহাঙ্গীর খান, ‘ফিল্ম সেক্টরটি হলো ভাগ্য’, কালের কণ্ঠ, ২৫ নভেম্বর ২০১৬।

6.         Alamgir Kabir, Cinema in Pakistan (Dacca : Sandhani Publications, 1969).

7.         Alamgir Kabir, Film in Bangladesh (Dacca: Bangla Academy, 1979).

8.         Alamgir Kabir, This was Radio Bangladesh: 1971, 2nd ed. (Dhaka : Bangla Academy, 2016) , 1st ed. 1984.

 

 লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর