নীলু ম্যানগ্রোভ বনে; এক কাঁথাবুড়ির আদরস্নেহে বেড়ে ওঠে। কাঁথাবুড়ির আপন বলতে কেউ ছিল না। এখন নীলুই কাঁথাবুড়ির প্রাণ ‘আত্মার-আত্মা’। এই বিশাল ধরণির বুকে নীলুরও জানা মতে কাঁথাবুড়ি ছাড়া কেউ নেই। কাঁথাবুড়ি একদিন কাঠ জোগাড় করতে গভীর অরণ্যে ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে সূর্যেরও তাপ প্রখর হতে থাকে। কাঁথাবুড়ি পিপাসায় কাতর তাই পানি খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান পেল না।
হঠাৎ করে কাঁথাবুড়ির কর্ণে একটা শিশুর কান্না ভেসে এলো। সে বলল, এই গভীর অরণ্যে শিশুর কান্না! সে বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য শিশুর কান্নার ধ্বনি অনুসরণ করে যেতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর; কাঁথাবুড়ি একটা নদীর তীরে চলে গেল। নদী ভরা জল দেখে কাঁথাবুড়ি ভীষণ খুশি। সে খুশিতে হাঁটুজলে নেমে, তৃষ্ণা মেটাতে জল খেতে আরম্ভ করে। আবারও তার কানে শিশুর কান্নার ধ্বনি ভেসে এলো। তখন তার মনে হয়েছে। শিশুটি তার কাছাকাছি আছে। কিন্তু দেখতে পায় না।
অনেক খোঁজাখুঁজি করছে। কিন্তু পেলো না। ভাবল, হয়তো মনের ভুল। হাঁটতে থাকল। কিছুক্ষণ পর আবারও শিশুর কান্না। নদীর তীরে গিয়ে দেখে কেউ নেই। তবে, বেশ বড়সড়ো একটা হাঁড়ি পানিতে ভাসতে দেখে। কাঁথাবুড়ি একটু চুপচাপ হয়ে ভাবছে। এত বড় হাঁড়ি তো আমি আর কখনো দেখিনি। এত বড় হাঁড়ি কে এভাবে ভাসিয়ে দিল? কাঁথাবুড়ি হাঁড়ির কাছে যাবে ভাবছে। তখনই শিশুটি কেঁদে উঠল। কাঁথাবুড়ির বুঝতে আর বাকি রইল না। শিশুটি যে হাঁড়ি থেকে কান্না করছে।
কাঁথাবুড়ি এক দৌড়ে হাঁড়ির কাছে গেল। হাঁড়ির ওপরটা পাতলা এক ধরনের কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। কাঁথাবুড়ি কাপড় সরিয়ে দেখে। ফুটফুটে একটা মেয়ে। সে কোলে তুলে দুই গালে চুম্বন দিতে লাগল। আর বলছে খোদাই জানে কোন মায়ের সন্তান; এভাবে অযত্নে হাঁড়িতে ভাসিয়ে দিল।
কাঁথাবুড়ি বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল নিজের কুঁড়েঘরে। বাচ্চাটা দেখতে বেশ ভালো ছিল বলে কাঁথাবুড়ি নিজেই নাম রাখে নীলু।
এখন কাঁথাবুড়ি ছোট্ট নীলুকে নিয়েই পেতেছে ছোট সুখের সংসার।
নীলু ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল। কিন্তু নীলু চোখে একেবারেই দেখতে পায় না। নীলু প্রায় সময়ই বলত দিদিমা; আমি তো তোমাকে দেখতে পাই না। কাঁথাবুড়ি ভাবতে মনে হয় ইয়ার্কি-টার্কি মারে। তাই গুরুত্ব দিত না। কাঁথাবুড়িও বেশ কিছুদিন পর নীলুর হাবভাব দেখে বুঝতে পারল। নীলু রোজ দিদিমার কাছে বারবার প্রশ্ন করে দিদিমা সবকিছু অন্ধকার লাগে কেন? তুমিও কি সবকিছু অন্ধকার দেখ আমার মতো? কাঁথাবুড়ি কিছু না বলে, শুধু কাঁদে। নীলুকে আশ্বাস দেয় লক্ষ্মীসোনা আমার একদিন তুমিও সবকিছু উজ্জ্বল দেখতে পাবে। দিদিমার মুখের আশার কথা শুনে নীলু ভীষণ খুশি হয়।
একদিন সকাল বেলা; কাঁথাবুড়ি নীলুকে বলে পাত্রে তো কোনো চাল নেই লক্ষ্মী বোন? তুমি ঘরে থেক আমি চালের দেখি ব্যবস্থা করতে পারি কি না? আর হ্যাঁ আমি না আসা অবধি তুমি ঘর থেকে বাহির হবে না। নীলু উত্তরে বলে তাই হবে দিদিমা। দিদিমাকে বিদায় দিয়ে। আন্দাজে জানালার নিকট গেল। হালকা শীতল বাতাস বইছিল চারদিকে মরা গাছের ডালপালাগুলোও মটমট করছিল। নীলুর কাছে ধ্বনিটা বেশ মজার ছিল।
হাওয়ার সাথে ফুলেরও ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। নীলু আজ বায়না ধরছে ফুলের বাগে গিয়ে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ অনুধাবন করে আসবে। নীলু তো দেখতে পায় না। তাই ঘ্রাণকে কেন্দ্র করে দিদিমার বলে যাওয়া কথা ভুলে গিয়ে যেতে লাগল ফুল বাগে। বাগানটা খুব নিকটে ছিল। তাই নীলু বিনা বাধায় চলে যায়। তখন সেই বাগে খেলা করছিল প্রজাপতি আর নীলপরী। নীলুকে দেখে প্রজাপতি ও নীলপরী বলে তুমি কি রূপের পরী? নীলু বলল, তোমরা কে গো আর কোথায়? আর আমি কোনো পরী না! আমি এক অন্ধ মেয়ে! নাম নীলু।
প্রজাপতি আর নীলপরী বলে এসব কি বল গো অলক্ষণে কথা। তুমি আমাদের সাথে মজা করছ না তো? নীলু তখন বলে ওঠে, মোটেও না। প্রজাপতি আর নীলপরী পরীক্ষা করতে নীলুকে বলে, নীলু বলত আমরা কারা? আর দেখতে কী রকম?
নীলু বলল তোমরা কারা জানি না। তবে তোমরা দুজন-ই খুব কালো।
প্রজাপতি আর নীলপরী বুঝতে পেরেছে। নীলু যে আসলেই অন্ধ! তাই প্রজাপতি গিয়ে বলল, নীলুকে আমি প্রজাপতি আর আমি কালো না শুধু আমার গায়ে রামধনুর সাত রঙের ছোঁয়া। নীলু বলে ওমা। তাই! তাহলে তো তুমি খুব সুন্দর। নীলপরী এসে বলে নীলু আমি নীলপরী। আমার গায়ে শুধু রামধনুর নীল রং। সে বলে ওহ! তাই তুমি নীলপরী। দিদিমা একদিন রাতে পরীর গল্প শুনিয়েছিল। তারা নাকি মানুষের উপকার করে। নীলপরী বলে তোমার দিদিমা কিছু ভুল বলেনি।
নীলু বলে ওহ তাই! বেশ তাহলে তোমরা তো খুব ভালো। তোমাদের তো দেখতে পাই না। তাই আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। প্রজাপতি বলে নীলপরীকে বন্ধু তোমরা তো মানুষের উপকার কর তাহলে নীলুর চোখ ভালো করে দাও!
নীলপরী বলে আমিও তাই ভাবছি। দেখ বন্ধু এত সুন্দর একটা মেয়ে দৃষ্টিহীন। শুনতেই খারাপ লাগে। নীলুকে প্রজাপতি আর নীলপরী বলল, তুমি কি আমাদের দেখতে চাও? নীলু বলে হ্যাঁ। তবে কী করে সম্ভব। দিদিমা ও কতবার বলেছিল আমি নাকি কোনো একদিন সবকিছু উজ্জ্বল দেখতে পাব। দেখ আজও আমি কালো-ই (অন্ধকার) দেখতে পাই।
প্রজাপতি আর নীলপরী বলে ওঠে, সবকিছু উজ্জ্বল দেখার দিন আজও-ই তোমার। নীলপরী প্রজাপতিকে বলল, তোমার গায়ের সাতরং দিয়ে দুটো পুষ্পকে রাঙাতে। প্রজাপতি নীলপরীর কথামতো তাই করল। তারপর নীলপরী জাদুরকাটি দিয়ে নীলুর দুচোখ দুটো পুষ্প দিয়ে ঢেকে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ পর পুষ্প দুটো নিজ থেকেই মাটিতে পড়ে যায়। প্রজাপতি আর নীলপরী বলে, এবার নীলু চোখ খুলে দেখ। আমরা দেখতে কেমন? নীলু চোখ খুলে দেখে প্রকৃতিটা রূপকথার গল্পের মতো অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা। প্রজাপতি আর নীলপরীকে লাগে বঙ্গমাতার কপালের টিপ। নীলু আজ সুখী মানুষের মধ্যে একজন।
নীলু; প্রজাপতি আর নীলপরীকে বলল, তোমাদের কাছে চিরকাল ঋণী থাকব। প্রজাপতি আর নীলপরী বলে বন্ধু এসব কী বল? নীলু বলে তোমরা আমাকে বন্ধু বললে? তারা বলে হ্যাঁ তুমি তো আমাদের বন্ধু-ই। আজ থেকে আমরা তিনজন বন্ধু। প্রজাপতি আর নীলপরী। নীলুকে বলে এখন আমাদের যেতে হবে বন্ধু! নীলু বলে, বন্ধুরা আমি কোন রাস্তা দিয়ে এখানে এসেছিলাম আন্দাজ করতে পারছি না। তাই তোমরা আমার দিদিমার উঠোনে আমাকে দিয়ে আসতে পারবে?
তারা বলল হ্যাঁ, তারপর দিদিমার উঠানে দিয়ে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
নীলু কুঁড়েঘরের কাছে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। ডাক দিল দিদিমা, দিদিমা! দিদিমা রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল, কোথায় ছিলি হতচ্ছাড়ি। এই বলে দরজা খুলে দিল। নীলু গিয়ে দিদিমার হাতে ধরে বলে দিদিমা। তুমি বলতে না আমি একদিন সবকিছু উজ্জ্বল দেখতে পাব? দেখ আজ দেখতে পাচ্ছি। দিদিমা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। নীলুকে বলল, বল তো আকাশ দেখতে কেমন সে বলে নীল। দিদিমা বলে, তাই তো। জানতে চাইল কীভাবে কী হয়েছে। অবশেষে নীলু প্রজাপতি আর নীলপরীর উপকারের কথা বলে দিল।
দিদিমা বলে, দেখলে লক্ষ্মীসোনা আমার। পরীরা মানুষের উপকার করে। আর বলেছিলাম না! তুই একদিন সবকিছুই উজ্জ্বল দেখতে পাবি। নীলু বলে, হ্যাঁ দিদিমা তোমার কথাই আজ ঠিক হলো।