স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ৫৩ বছর অতিক্রম করেছে। প্রতি বছরই বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে আমরা এ হিসাব মিলাই। কীসের হিসাব, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির জমা-খরচ। এ হিসাব কোনো দিনই কড়ায় ক্রান্তিতে মেলে না। জানি তবুও ক্ষেপার পরশ পাথর খোঁজার মতোই স্লেটে ঢ্যাড়া কাটি। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সে ঐতিহাসিক ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’র মুখস্থ হয়ে যাওয়া লাইনগুলো আবার পড়ি। বারবার আউড়ে যাই এবং প্রতিবারই প্রত্যাশার পারদ চড়া হয়। তাতে বাড়তে থাকে হতাশা। কী হওয়ার ছিল, আর কী হলো! এ বিষণ্নতা শুষে নেয় স্বাধীনতা দিবসের যাবতীয় আহ্লাদ। উৎকট থেকে উল্লাসের উৎরোল। অথচ স্বাধীনতা তো এক চূড়ান্ত প্রাপ্তির ঠিকানা। বিদেশি শাসনমুক্ত দেশবাসী নিজের মতো করে বাঁচবে বলেই না এত সংগ্রাম আত্মত্যাগ আর শোণিত পিচ্ছিল সরণিতে মৃত্যুর দীর্ঘ কাতার। এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বিভেদ আর বৈচিত্র্যের মধ্যেই অঙ্গীকার করেছিল, সবাই অন্তত খেয়ে পরে থাকার মতো এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে। প্রয়োজন ছিল সুশাসন আর সুনীতির। কিন্তু এ টুকুই পাওয়া গেল না। বরং দুর্নীতি আর দুঃশাসনে ছেয়ে গেল সারা দেশ। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ থেকে বিচারব্যবস্থা প্রতিটি স্তরেই বাসা বাঁধল নীতিহীনতা আর অরাজকতা। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা থাকল না। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল একটা সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না দারিদ্র্য, থাকবে না হীনমন্যতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, দলীয়করণ ও ধর্ষণের মতো পরিস্থিতি ও পরিবেশ। থাকবে প্রাচুর্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্পদ, আর এ সম্পদের মালিক হবে দেশের মানুষ। কিন্তু সে আশা বা আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি আজও। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আরও কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হবে।
অমর্ত্য সেনের ‘দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস’ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে ন্যায়ের স্বরূপ। রলসের ১৯৫৮-এর বিখ্যাত ধারণা ‘জাস্টিস এজ ফেয়ারনেসসহ পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের যাবতীয় বক্তব্যকে খণ্ডন করে অমর্ত্য বোঝাতে চেয়েছেন বাস্তবে কোনো আদর্শ সামাজিক ন্যায় ব্যবস্থা সম্ভবই নয়। ন্যায় বরাবরই এক আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। তাই তিনি জোর দিয়েছেন প্রতিকারযোগ্য অন্যায় (রেমিডিয়েবল ইনজাস্টিস)-এর অপসারণে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ন্যায় নয়, নীতিই প্রধান হিসাবে গণ্য হোক। প্রখর নীতিবোধই পারে একটি সমাজকে ন্যায়ের রাস্তায় নিয়ে যেতে। অমর্ত্যরে সারস্বত আমরা বরাবরই লক্ষ্য করেছি সুমহান ঐতিহ্যের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য। ঐতিহ্যের পুনঃনির্মাণের সে অভীপ্সাই প্রতিফলিত হয়েছে ন্যায় সম্পর্কিত তার নবতম ধারণায়। কিন্তু এ ইশারা তো আমাদের সংবিধানেও রয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের সুবিস্তৃত অঙ্গনে প্রবেশাধিকার থাকে শুধুই সুনীতির। স্বাধিকার, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব তো আসলে তিনটি মৌলিক নীতিবোধ, আমাদের পৌঁছে দেবে চতুর্থ তথা অন্তিম লক্ষ্যে হচ্ছে ন্যায়।
এর মধ্যে সংঘাত থাকবে, থাকবে পরস্পরবিরোধী স্বার্থের সংঘর্ষ। কিন্তু আমরা তো জানতাম, মিলাবেন, তিনি মিলাবেন। ফলে সমন্বয় ভাবনাও কাজ করবে অগোচরে। বিভিন্ন লেখক তাদের সাম্প্রতিক রচনাগুলোতে বারবার আমাদের এ কথাই বলেছেন। দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাচ্ছেন, শুধু শ্রেণি পরিচয় থেকেই সংঘাতের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর জন্য আমাদের যেতে হবে পরিচিত তাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে।
কিন্তু বাংলাদেশি গণতন্ত্রে মুশকিলের জায়গা যে অন্যত্র। শিল্প না কৃষি, নদী বাঁধ হবে কি না ইত্যাদি এবং সমজাতীয় ন্যায়-সংকল্পজনিত প্রশ্নের বাইরেও রয়েছে আমাদের না-শাসন এবং দুঃশাসনের অজস্র উপস্থিতি। অমর্ত্যরে ‘প্রতিকারযোগ্য অন্যায়’ তত্ত্ব সম্ভবত এসব ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক।
রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীর চাপে পুলিশ যখন দুষ্টের দমনে এগিয়ে না এসে শিষ্টকেই ফাটকে পুরে দেয়, দেশের অগ্রগণ্য আইনজীবী যখন খুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষীকে উৎকোচ প্রদান এবং ভীতি প্রদর্শন করেন, দেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশন যখন বছরের পর বছর ধরে টাকার বিনিময়ে প্রশাসনিক সেবার শীর্ষ আধিকারিকদের নিযুক্তিদের কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত দেশবাসীদের যখন নিজেদের হকের পাওনা আদায়ের জন্য কোটি কোটি টাকা উৎকোচ প্রদান করতে হয়, তখন গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা সত্যিই বিপন্ন হয় এবং ন্যায় শাস্ত্রের কোনো অভিধানেই এর প্রতিকার লেখা থাকে না। সমস্যাটি আরও ভয়াবহ হয় যখন দেখি, ভোটাররা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীকে বাতিল করে পুনরায় দুর্নীতিগ্রস্ত, অরাজক শাসকদেরই বেছে নেন।
এভাবে অসংখ্য প্রতিকারযোগ্য অন্যায়ই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিচ্ছে।
আমাদের গণতন্ত্রের এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলনের জন্য সুখবর নয়। আমাদের অবশ্যই এসব বিষয় বিবেচনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট