হাজার বছর ধরে অমরত্বের ফর্মুলা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সফল হননি আজও। অথচ, প্রাণিজগতে এমন একটি প্রাণী আছে যে নিজেই নিজের মৃত্যু ঠেকাতে পারে। সমুদ্রের নীল জলরাশির গভীরে লুকিয়ে থাকা অলৌকিক প্রাণীটি হলো টারিটোপসিস ডোহরনি বা জেলিফিশ। এই অতি ক্ষুদ্রাকার জেলিফিশটির অসাধারণ জৈবিক ক্ষমতা সমগ্র বৈজ্ঞানিক সমাজকে হতবাক করে দিয়েছে। মাত্র ৪-৫ মিলিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট প্রাণীটিকে ‘অমর জেলিফিশ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ এটি এক অনন্য জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বার্ধক্যের শৃঙ্খল ভেঙে অমরত্ব লাভে সক্ষম।
এই প্রজাতির আদি নিবাস ভূমধ্যসাগর হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এটি বিশ্বের বিভিন্ন উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ সমুদ্রাঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে। জেলিফিশের সরল, স্বচ্ছ ও ঘণ্টাকার দেহে রয়েছে সূক্ষ্ম টেন্টাকেলের (কাঁটা) সারি। এই সরল গঠনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অমরত্বের রহস্য।
এই জেলিফিশের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, এর ‘ট্রান্সডিফারেনশিয়েশন’ নামক কোষীয় পুনঃযৌবন প্রক্রিয়া। সাধারণ জেলিফিশের জীবনচক্রে দুটি প্রধান পর্যায় থাকে; পলিপ (বাচ্চা) ও মেডুসা (প্রাপ্তবয়স্ক) পর্যায়। কিন্তু টারিটোপসিস ডোহরনি যখন কোনো সংকটের সম্মুখীন হয়, যেমন গুরুতর আঘাত, তীব্র পুষ্টির অভাব, পরিবেশগত চাপ বা এমনকি স্বাভাবিক বার্ধক্য, তখন এটি নিজের সমস্ত বিশেষায়িত কোষগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে ফেলে। এই প্রক্রিয়ায় পূর্ণবয়স্ক জেলিফিশটি প্রথমে নিজেকে একটি সিস্ট বা সংকোচিত অবস্থায় রূপান্তর করে, পরে সম্পূর্ণভাবে পলিপ বা বাচ্চা অবস্থায় ফিরে যায়, যেখান থেকে এটি আবার নতুন করে জীবনচক্র শুরু করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রক্রিয়াটি সম্ভব হয় প্রাণীটির দেহে বিদ্যমান বিশেষ ধরনের স্টেম সেলের মাধ্যমে। এই স্টেম সেলগুলো যে কোনো ধরনের বিশেষায়িত কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতির জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এর জিনগত রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। তারা বিশেষভাবে লক্ষ করেছেন Td-DUX এবং Td-POU নামক দুটি বিশেষ জিনকে, যা এই অনন্য ক্ষমতার জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়।
তবে এই ‘অমরত্ব’ শব্দটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ, শিকারি প্রাণীর আক্রমণ, সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান অম্লতা, প্লাস্টিক দূষণ, তেল ছড়ানো এবং বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ প্রাণীটির মৃত্যু ঘটাতে পারে। তবে প্রাকৃতিকভাবে বার্ধক্যজনিত মৃত্যু সহজেই এড়াতে পারে জেলিফিশটি, যা পৃথিবীর অন্য কোনো পরিচিত প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীটির অমরত্বের রহস্য উন্মোচনে নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গবেষকরা আশা করছেন, প্রাণীটির জৈবিক ক্ষমতাকে বুঝতে পারলে মানবদেহের জন্য নানা ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি বিকশিত করা সম্ভব হবে। এতে ক্যানসার কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ুরোগ (আলঝেইমার্স, পারকিনসন্স) নিরাময়, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পুনর্গঠন এবং সম্ভবত বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীরগতির করার পথ উন্মোচিত হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়