সারাক্ষণই কি তাঁর চোখ বন্ধ ছিলো? একবারও কি তিনি চোখ খুলে দেখেছিলেন- কাদের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন? মনে করতে পারছি না। সাধারণত মঞ্চে যারা পারফর্ম করেন, গান করেন- তারা অডিয়েন্সের সাথে এক ধরনের যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি সেগুলোর ধারে কাছেও গেলেন না। সত্যি বলতে কি তার সামনে কোনো শ্রোতা আছে কী নেই- সেদিকেও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন নিষ্পৃহতা নিয়ে কেউ মঞ্চে পারফর্ম করে? সেই গানও কেউ শুনে? হ্যাঁ, শুনে। কেবলি শুনেই না, শিল্পীর সাথে একাত্ম হয়েই যেন শুনে। জেমস এর শো না দেখলে এ কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন হতো।
সত্যি বলতে কি, ব্যান্ড গানের ফ্যান আমি না। জেমসেরও না। তবু টরন্টোয় জেমস এর শো দেখতে গিয়েছিলাম রবিবারের সন্ধ্যায়। অডিটরিয়ামে ঢোকার জন্য এতো দীর্ঘ লাইন? গান শুনতে মানুষ এমন লাইন ধরে অডিটরিয়ামে ঢুকে? ঢুকছে তো! ক্রাউডটা আসলেই বেশ বড়। আশপাশের শহর থেকেও মানুষ এসেছে ঢাকা ক্লাব ভ্যানকুভারের ব্যবস্থাপনায় শাহিন খান, নাসির কাশেম, ম্যাক আজাদ, লিটন কাজী আলম, হালিম শাহ ও লোটাস কোমল এর সহযোগিতায় ‘নগর বাউল জেমস লাইভ ইন টরন্টো’ শীর্ষক এই শোতে। টরন্টো প্যাভিলিয়নের হলরুমটা ভরে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অনেক শ্রোতা। জেমস মঞ্চে উঠলেন কেমন একটা নিষ্পৃহ ভঙ্গি নিয়েই। জেমস এর অবয়বে যতটা নিষ্পৃহভাব পুরো অডিটরিয়ামে যেন তার অনেক গুণ বেশি প্রাণচাঞ্চল্য। জেমস গান ধরার আগেই যেন পুরো অডিটরিয়াম সুরের মূর্ছনায় নেচে উঠে। সুরের টুং টাং শুনেই এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ কিভাবে বুঝে যায়- জেমস এখন কোন গানটা গাইবেন। গানের লিরিকগুলোও এতো মানুষের মুখস্ত।
আগেই বলেছি, ব্যান্ড গানের আমি তেমন একটা ফ্যান আমি না। তবু জেমস আমাকে টেনে রাখে। অডিটরিয়ামের চারপাশে তাকাই। পুরো অডিটরিয়ামটাই নাচছে। তারা গাইছেও। যে মেয়েটা শাড়ি পরে এসেছে সে নাচছে, যে মেয়েটা টি-শার্ট পরে এসেছে সে নাচছে, যে মেয়েটা মাথায় হিজাব পরে এসেছে সেও নাচছে। শ্রোতার আসনের পুরুষগুলো নাচছে। সিটে বসে থাকা আমার মতো স্বল্প কয়েকজনকে যেন বেমানান লাগছিল এই আসরে।
মাঝখানে কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে কতক্ষণ গান গেয়েছেন জেমস? মনে পড়ছে না। ‘বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে – আপনাদের শুভেচ্ছা, বলে জেমস যখন মঞ্চ থেকে নেমে যেতে থাকেন, তখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না শো আসলে শেষ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ যেন আয়োজকরাও হতভম্ব ছিলেন। কয়েক মিনিট পর যখন সমাপ্তির ঘোষণা আসে- তখনো শ্রোতারা অডিটরিয়ামে স্থির, যেন এক্ষুণি জেমস আবার গাইতে শুরু করবেন। জেমস আর গাইবেন না- সেটা বুঝতেও যেন খানিকটা সময় লেগে যায়। অনুষ্ঠানের সাথে, শিল্পীর সাথে এতো মিশে গিয়ে গান শুনতে, এমন তন্ময় হয়ে গান শুনতে, ক্রাউডের দিকে আপাত দৃষ্টিতে নিষ্পৃহ থাকা একজন শিল্পীর সাথেও শ্রোতাদের এমন অসাধারণ নিবিড় যোগাযোগ খুব বেশি কি দেখা যায়?
এমন অসাধারণ একটি সন্ধ্যার সাক্ষী হবার সুযোগ করে দেবার জন্য ’জেমস লাইভ ইন টরন্টো’কে ধন্যবাদ বলতেও দ্বিধা হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার ধন্যবাদের চেয়েও অনেক বড় কিছু করেছে তারা।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি-প্রতিদিন/মাহবুব