১৭ মে, ২০২২ ১১:৫২

‘সত্যজিতের নাম বদলে অপরাজিত রাখতে হয়, এটি বড় বেদনার’

তসলিমা নাসরিন

‘সত্যজিতের নাম বদলে অপরাজিত রাখতে হয়, এটি বড় বেদনার’

অপরাজিত ছবিতে জিতু

কিছুদিন আগে দেখেছি থিংকিং অফ হিম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সম্পর্ক নিয়ে আর্জেন্টিনার পরিচালকের বানানো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, যে ছবিতে কোনও চরিত্রের নাম বদলানো হয়নি, আর আজ দেখেছি অপরাজিত, সত্যজিৎ রায়ের জীবনের একটি অংশ নিয়ে বাঙালি পরিচালকের বানানো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, যে ছবিতে সব চরিত্রের নাম বদলানো হয়েছে। দুটো ছবির মধ্যে ভালো আমার কোনটি মনে হয়েছে? নিঃসন্দেহে অপরাজিত। দুটো ছবির যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো, রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে ভিক্টর ব্যানার্জিকে অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে, এবং সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে জিতু কামালকে প্রায় অবিকল সত্যজিতের মতো দেখতে।

আমি সাধারণত কোনও ছবি একবারের বেশি দেখি না। খুব যদি অসাধারণ কিছু হয়, তাহলে দু'তিন বার দেখি, এর বেশি নয়। তবে পথের পাঁচালি ছবিটি  জীবনে যত ছবি আমার একাধিকবার দেখার তালিকায় আছে, তার মধ্যে শীর্ষে। হয়তো পঞ্চাশ-ষাটবার দেখা হয়েছে। এক সময় ভালো ছবি সংগ্রহ করার আমার এক শখ ছিল। যেমন ছিল ব্যক্তিগত  সংগ্রহের  বইয়ের লাইব্রেরি, তেমন ছিল ব্যক্তিগত সংগ্রহের ভিডিও ক্যাসেট এবং ডিভিডির  লাইব্রেরি। নিজের সংগ্রহে থাকা পথের পাঁচালি  তো একাধিকবার নিজে দেখেছিই, স্বজন বন্ধুদের দেখাতে গিয়েও দেখেছি অনেকবার। যতবারই দেখেছি, চোখ জলে ভেসেছে, বিশেষ করে অপু যখন পড়শি-মেয়ের হারিয়ে যাওয়া পুঁতির মালাটি দুর্গার জিনিসপত্রের মধ্যে পেয়ে কাউকে না জানিয়ে পুকুরে ছুড়ে দেয়, কেউ যেন না জানে দিদি চুরি করেছিল মালাটি।

এই পথের পাঁচালি ছবিটি কী করে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন, সেটির অনেকটাই জানা ছিল, আজ  আরও বেশি জানা হলো। যাদের একাধিকবার পথের পাঁচালি না দেখা হয়েছে, যাদের অন্তরে পথের পাঁচালির প্রতিটি দৃশ্য  গাঁথা নেই, পথের পাঁচালির নেপথ্য কাহিনী ‘অপরাজিত’ তাদের কতটা ভালো লাগবে আমি জানি না। তবে আমি তো আগাগোড়াই উপভোগ করেছি।

বিখ্যাত কিছু চলচ্চিত্রের নির্মাণকৌশল নিয়ে চমৎকার সব তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনও একটি চলচ্চিত্রের নির্মাণকে প্রধান বিষয় করে, সত্য কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে, ফিচার ফিল্ম খুব কমই তৈরি হয়েছে। বাংলায় তো সম্ভবত এই প্রথম।

আমি জানি না কী কারণে সত্যজিৎকে অপরাজিত, বিজয়াকে বিমলা, অপুকে মানিক, মানিককে অপু,  করুণাকে বরুণা,  বাইসাইকেল থিফকে বাইসাইকেল রাইডার, সুকুমার রায়কে শ্রীকুমার রায়, পথের পাঁচালিকে পথের পদাবলি  করা হয়েছে। নাম না বদলালে, আমার মনে হয়, যত ভালো হয়েছে ছবিটি, তার চেয়ে আরও ভালো হতো। কত প্রাচীনকালের যোদ্ধা, রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিক, কবি, বিপ্লবীর  বায়োপিক নির্মিত হয়েছে, খুব সামান্যই  তথ্য সম্বল করে। তাঁদের  জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি সংলাপ  বাস্তবের সঙ্গে নিশ্চয়ই শতভাগ মেলে না, কিন্তু তাই বলে চরিত্রের নাম বদলে  দেওয়া হয়নি তো! লিঙ্কন ছবিতে আব্রাহাম লিঙ্কনের নাম হারবাহাম শিঙ্কন হলে আদৌ কি ভালো দেখাতো?  হিচকক ছবিতে হিচককের নাম তো বদলে দেওয়া হয়নি। ম্যালকম এক্সকে নিয়ে তৈরি ম্যালকম এক্স, রে চার্লসকে নিয়ে তৈরি রে; কোথাও তো নাম বদলে দেওয়া হয়নি। পথের পাঁচালি  নির্মাণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় কী কী সমস্যার সামনে পড়েছিলেন, কী কী ঘটনার মধ্য দিয়ে  গিয়েছিলেন, তা নিজে  যেমন তিনি বলেছেন লিখেছেন, তাঁর কাছের মানুষেরাও বলেছেন লিখেছেন। সুতরাং তাঁকে নিয়ে হওয়া বায়োপিক বাস্তবের সঙ্গে মেলাই স্বাভাবিক। তারপরও পরিচালক অনীক দত্তকে সত্যজিতের নাম বদলে অপরাজিত রাখতে হয়, এটি বড় বেদনার।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর