মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আরও আসছে লাখে লাখে

নতুন ঢুকেছে ৫০ হাজার, অপেক্ষায় সব রোহিঙ্গাই, প্রশাসন হিমশিমে ফের নৌকাডুবি ১৩ লাশ উদ্ধার

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, আঞ্জুমানপাড়া (কক্সবাজার) থেকে

আরও আসছে লাখে লাখে

কক্সবাজারের উখিয়ায় সীমান্তের কাছে আঞ্জুমান এলাকায় খোলা আকাশের নিচে গতকাল হাজার হাজার রোহিঙ্গা —রোহেত রাজীব

রোহিঙ্গা স্রোত থামছেই না। রাখাইন রাজ্যে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা কত তা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। রবিবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত আঞ্জুমানপাড়া ও হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অন্তত অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকে। তারা রাতদিন ছিল নাফ নদের তীরে খোলা আকাশের নিচে। দিনভর চিৎকার-চেঁচামেচি আর ক্ষুধাকাতর বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ভারি হয় ওই এলাকা। অবশ্য গতকাল সন্ধ্যায় বিজিবির সহায়তায় ধাপে ধাপে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে। নাইচাদং ও কুয়াংচিদং দিয়ে আসা কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ জানান, মংডু, বুসিদং ও রাসিদংয়ে এখনো ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তবে সীমান্তবর্তী গ্রামে কেউ নেই। রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করার তত্পরতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাই সময়-সুযোগ বুঝে স্রোতের মতো কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা। এখনো সীমান্তবর্তী আরাকান গ্রামগুলো জ্বলছে।

জানা যায়, বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসনও। বিশেষ করে বিজিবি, পুলিশ এমনকি নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া সেনা সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের সামলাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণসহ সামগ্রিকভাবে দেখভাল করছে প্রশাসন। টেকনাফ ও উখিয়ায় আগের থাকা প্রায় ৫ লাখের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গা। এর পরও প্রতিদিনই আসছে। এদের ভবিষ্যৎ কী তাও অজানা। তার পরও প্রাথমিকভাবে সরকার কুতুপালং ও বালুখালীতে ৩ হাজার একর জমিতে তাঁবু তৈরি করে থাকতে অনুমতি দিয়েছে। গতকাল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসার পথেও মগদের হামলার শিকার হতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের। একসঙ্গে যাত্রা করা রোহিঙ্গাদের কেউ পেছনে পড়লেই তাদের ওপর হামলা করে মগরা। এমন ঘটনার বিবরণও দেন একাধিক নারী। তারা জানান, নারীদের শেষ সম্বলটুকু থাকা শরীরের সোনা-গয়নাও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে মগরা। এমনকি নিয়ে আসা টাকাপয়সাও লুটে নিয়ে যায় তারা। আবার সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় মাঝিরাও তাদের কাছে সর্বশেষ যা টাকাপয়সা ও গয়না ছিল, তাও নিয়ে যায়। এমনকি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।

দীর্ঘ সময়ে হেঁটে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনা যায়। উনিশ বছরের আজিদা বেগম। ছয় দিন আগে বুসিদংয়ের মগনামা পাড়া থেকে স্বামীর সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে পাড়ি জমান বাংলাদেশের উদ্দেশে। শেষ পর্যন্ত হেঁটে অনাহারে-অর্ধাহারে রবিবার রাতে বাংলাদেশের আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে এ দেশে আসেন। শুধু কি নিজের প্রাণ! আজিদা নিজে অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী খুইল্যা মিয়া একা এই স্ত্রীকে নিয়ে ওপারে নির্যাতন আতঙ্কে কাটানোর আর সাহস পাননি। তাই দীর্ঘ পথ হেঁটে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বুধবার রাতেই ঢোকেন বাংলাদেশে। দুর্গম উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে আজিদা বেগমের যে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ, তার পরও বিরামহীন হাঁটতে হলো সারা রাত। এভাবে দুই দিন দুই রাত হাঁটার পর মিয়ানমারের ‘তামি’ নামের একটি স্থানে খোলা আকাশের নিচে শনিবার ভোর ৭টার দিকে পথেই জন্ম দেন আজিদা তার প্রথম সন্তানকে। প্রতিবেশী যারা দলে ছিলেন, তারা সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন সদ্য প্রসূতি মা ও নবজাতককে রক্ষার জন্য। এরপর আজিদা আর হাঁটতে পারলেন না। স্বামী খুইল্যা মিয়া ও দেবর আজিজ মিয়ার কাঁধে ভর করে আরও তিন দিন সীমাহীন দুর্ভোগের পর গতকাল সকাল ৯টায় বাংলাদেশে ঢোকেন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়ার নাফ নদের শাখা নদের কিনারে বিলের একটি বড় আইলে (ডেইল) ছাতা মাথায় বসে আছে এক কিশোরী। দায়িত্বরত এক বিজিবি সদস্য কিশোরীটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই মহিলার একটা নতুন বাচ্চা হয়েছে। মনে হয় আজকেই হয়েছে।’ বিজিবি সদস্যের কথা শুনে তার সঙ্গে এবং স্বামী খুইল্যা মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এই মানবিক বিপর্যয়ের মুখে তাদের প্রথম শিশু কন্যার জন্মকথা। শুধু আজিদা বেগম নন। এ রকম আরও শত শত নারী-শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও যুবক-যুবতীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মিয়ানমার তাদের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যটিকে রোহিঙ্গাশূন্য করছে। সর্বশেষ মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও মগ-মুরংদের হাতে খুন-ধর্ষণ ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গত সোমবার রাত ৯টা থেকে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে জড় হয় অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তাদের কারও কাছে কোনো খাবার নেই, পানি নেই, নেই তেমন অর্থকড়ি। খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড রোদে ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত শিশুদের কান্নার রোল। আহত রোহিঙ্গাদের চিৎকার ও স্বজনহারাদের আর্তচিৎকারে এপারের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ভরদুপুরে তৃষ্ণার্ত বাচ্চাদের নাফ নদের গরম পানিও খাওয়াতে দেখা যায়। সদ্য প্রসূত বাচ্চা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মানুষকে প্রখর রোদের তাপে দুর্বল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। অবশ্য গতকাল বিকালে নতুন রোহিঙ্গাদের কুতুপালংয়ে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়। অবশ্য দুর্দশাগ্রস্ত এসব রোহিঙ্গার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায় হেল্প দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, বাংলাদেশ অফিস নামে এক এনজিও প্রতিষ্ঠানকে। সংস্থাটির কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর ইঞ্জিনিয়ার সুজন খন্দকারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রান্না করা খাবার নিয়ে আসার পাশাপাশি রুটি, কলা, বিস্কুট ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করে।দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এক পিতা তার তিন-চার বছরের একটি সন্তানকে বাটিতে করে খেতে দিলেন আঞ্জুমানপাড়ার বিলের ঘোলা পানি। নাফ নদের শাখা নদের তীরে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গার ভিড় ঠেলে কিছু দূর যেতেই দেখা গেল এক মা তার সদ্য প্রসূত বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন এখানকার কারও দেওয়া একটি লিচি জুস। কারণ হিসেবে মা দিল আফেজ বেগম জানালেন, চার দিন ধরে তিনি তেমন কিছু খেতে পাননি, তাই তার বুকে দুধ নেই। শিশুর কান্না থামাতে আর কিছু না পেয়ে বড়দের জুস খাওয়াচ্ছেন।

সেতারা বেগম। বয়স বড়জোর ২০। ছোট বোনের কোলে মাথা রেখে আঞ্জুমানপাড়ার খালপাড়ে শুয়ে আছেন। পাশেই বসা স্বামী আবদুর রহমান জানালেন, তারা ১০ দিন আগে বুসিদংয়ের ঘুনারোয়া এলাকা থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন। তাদের দুই বছরের একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। নাম মোহাম্মদ আয়াছ। স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইবা অসুস্থ, গর্ভবতী। গতকাইল রাইতভর না খাই এডে আছিলাম। নৌকাত গরি পার অইতে একজনের তুন ১০ হাজার কায়েত (বর্মি টাকা) গরি লই ফেলাইয়ি। বহুত লোকরে মিলিটারি ও মগ অক্কল আইবার সমত কাটি ফেলাইয়ি।’ (উনি অসুস্থ, গর্ভবতী। গতকাল রাত থেকে না খেয়ে এখানে আছি। নৌকায় করে পার হতে জনপ্রতি ১০ হাজার কায়েত করে নিয়ে ফেলেছে। অনেক লোককে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগরা আসার সময় কেটে হত্যা করেছে।)

রবিবার রাত সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের বুসিদং চৌপারাং থেকে আঞ্জুমানপাড়ায় আসা মোহাম্মদ হারুন জানান, তিনি সাত দিন আগে ঘর থেকে বের হয়েছেন মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন ও স্ত্রী-পুত্রসহ নয়জনকে নিয়ে। রবিবার সন্ধ্যায় মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মুরংপাড়ায় মিলিটারি ও মুরংদের বসানো চেকপোস্টে পড়েন তারা। এ সময় তার ছোট ভাই মোহাম্মদ ফারুকের (১৮) কাছে বেশ কিছু টাকা ও ছোট বোন খালেদার (১৬) জামার ভিতর কিছু স্বর্ণালঙ্কার লুকানো ছিল। মুরং ও মিলিটারিরা টাকা ও স্বর্ণগুলো নিয়ে ফেলার সময় বাধা দিলে তারা ফারুক ও খালেদাকে আটকে রাখে। পরে শুনেছি তারা আমার ভাই-বোনকে জবাই করে মেরে ফেলেছে। আমাদের পেছনে যারা আসছিল, এদের অনেকেই তাদের লাশ দেখেছে বলে জানিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর