শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেই পথ সেই রাজ

আগের মতোই দৌরাত্ম্য বিশৃঙ্খলা, হারিয়ে গেছে ইমারজেন্সি লেন ও সারিবদ্ধ চলাচল

জুলকার নাইন

সেই পথ সেই রাজ

সড়কে বন্ধ হচ্ছে না বিশৃঙ্খলা। মাঝ রাস্তায় উঠানো হচ্ছে যাত্রী। পথচারীরাও মানছেন না কোনো নিয়মকানুন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দুপুর তখন ১২টা। মিরপুরের সাড়ে এগারো, বনলতার মোড়। একেবারে মোড় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাস। হেলপার হাঁকডাক দিচ্ছে যাত্রী তোলার জন্য। রিকশা ও সিএনজিগুলো মোড় ঘুরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য হর্ন বাজাতে থাকলেও সেদিকে বাস ড্রাইভারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ পর বাসের হেলপার উল্টো সিএনজি চালককে ধমকিয়ে বলল, ‘যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছিস, খাড়া বেটা’। তিন-থেকে চার মিনিট এমন চলতে থাকলে হঠাৎ আরেকটি বাস এলো প্রজাপতি পরিবহনেরই। সেটি এসেই কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই চলন্ত অবস্থায় ঠেকিয়ে দিল আগের বাসটির আগে এবং ঠেলতে থাকল সামনের দিকে। আগের বাসের ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকল। পেছনের বাসের ধাক্কায় এগোতে থাকল সেই বাস। কমপক্ষে পাঁচ মিনিট পর প্রথম বাসটি স্টার্ট করে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল ১২ নম্বরের দিকে। পরের বাসটি দাঁড়িয়ে রইল ঠিক মোড়ের মাঝ বরাবর।

কিছু দূর এগিয়ে পূরবীর কাছাকাছি সেতারা মোড়ে রাস্তার মধ্যে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল স্বাধীন এক্সপ্রেসের আরেকটি বাসকে। মিরপুর ১২ থেকে মাওয়া রুটের স্বাধীন এক্সপ্রেস, এখানেই কেন যেন ঘুরিয়ে ফেলতে চাইছে বাসটিকে। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বচসা চলছে বাস স্টাফদের। কালশীর মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ লাইসেন্স চেক করতে থাকায় অদূরে কবরস্থানের সামনে থেকে ফিরে যাওয়ার ধুম লেগেছে লেগুনা চালকদের। সপ্তাহব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরার পর এমনটাই ছিল ঢাকার ট্রাফিক পরিস্থিতি। ট্রাফিক সপ্তাহ চলতে থাকায় পুলিশ কাগজপত্র পরীক্ষা করার দিকে মনোযোগী থাকলেও রাস্তায় দেখা যায় পুরনো বিশৃঙ্খলা। গতকাল পর্যন্ত ছিল বিশৃঙ্খলার চিত্র। এটা শুধু বাস বা গণপরিবহন চালকদের ক্ষেত্রে নয়, প্রাইভেট কার, রিকশা কিংবা  মোটরসাইকেল চালক ট্রাফিক আইন মানছেন না। দ্রুত যাওয়ার জন্য সবাই এলোমেলোভাবে ছুটে চলছেন। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে, যাত্রীরা হাত দেখিয়ে থামতে বলছে বাসকে। ট্রাফিক আইনের দ্রুত গতির গাড়ির এক লাইন, অযান্ত্রিক বাহনের এক লাইন- এসবের তোয়াক্কা করছেন না কেউ। এমনকি শিক্ষার্থীদের দেখানো ইমারজেন্সি লেন যেন হারিয়ে গেছে। বুধবার দুপুরে রামপুরায় দীর্ঘ সিগন্যালে একটি অ্যাম্বুলেন্সকে ক্রমাগত সাইরেন বাজাতে দেখা গেল। কিন্তু কেউ ভ্রুক্ষেপ করছেন না সেদিকে। সিগন্যাল ছাড়ার পর অন্য সাধারণ গাড়ির মতোই পথ চলতে হলো অ্যাম্বুলেন্সটিকে। মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট ব্যবহারের সংখ্যা বাড়লেও ফুটপাথ বা উল্টো পথে যাত্রা থামেনি। গতকাল বিকাল ৪টায় কুড়িল নিকুঞ্জ গেট থেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালের দিকে উল্টো পথে চলতে দেখা গেল পুলিশের একটি গাড়ি। একই চিত্র পথচারীদের সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে। কেউ নিয়ম-কানুনের  তোয়াক্কাই করছে না। ফুটপাথ ও রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজের ব্যবস্থা থাকলেও অনেকেই সেসব ব্যবহার করছেন না। বিমানবন্দর সড়কের মতো দ্রুত গতি ও বিপজ্জনক সড়কেও লোকজনের দৌড়ে রাস্তা পারাপারের চিত্র বদলায়নি।  শেওড়া এলাকায় রাস্তা পারাপারের এ চিত্র ছিল রীতিমতো ভয়াবহ। তবে ট্রাফিক সপ্তাহ চলতে থাকায় বা আন্দোলনের জের ধরে গত তিন দিনই প্রায় সারাক্ষণ রাস্তার মোড়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা করছে পুলিশ। এরই মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার মামলা করা হয়েছে চলমান ট্রাফিক সপ্তাহে। কিন্তু সড়কের ব্যবস্থাপনার কাজে পুলিশের ভূমিকা ছিল সেই পুরনো পদ্ধতির, সিগন্যাল বাতির ব্যবহারও ছিল তথৈবচ।

হারিয়ে গেছে ইমারজেন্সি লেন : হঠাৎ জরুরি কোনো সমস্যা হলে ঢাকার যানজট কাটিয়ে কোনোদিক দিয়ে যাওয়ার বিকল্প পথ  নেই। যার কারণে অনেক সময় রাজপথে অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু রোগী নিয়েও রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকতে হয় ভুক্তভোগীদের। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্য ও উন্নত দেশগুলোর রাজপথে বিভিন্ন রকমের ‘ইমারজেন্সি লেন’ থাকে। কোনো কোনো দেশে জরুরি প্রয়োজনে হঠাৎ গাড়ি দাঁড়াতে এই লেন ব্যবহার হয়। আবার কোথায় প্রচণ্ড যানজটের মধ্যেও এই লেন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের গাড়ি যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও ঢাকার রাস্তায় এই দৃশ্য কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু সেটাই করে দেখিয়েছিল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এই ইমারজেন্সি লেন রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। কিন্তু আন্দোলন শেষ হওয়ার সঙ্গেই সব শেষ, হারিয়েই গেছে এই ইমারজেন্সি লেনের চিন্তা।

কন্ডিশন যাই হোক, কাগজ ঠিক চায় মালিক সমিতি : রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে গণপরিবহনের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা তা চেক করছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ইউনিয়ন ও কমিটিগুলো। গতকাল থেকে কমিটির সদস্যরা ঢাকার তিনটি টার্মিনালে প্রকাশ্যে টার্মিনালে থাকা বাসের কাগজপত্র চেক করছে। সায়েদাবাদ, গুলিস্তান ও মহাখালীতে ইউনিয়নগুলোর এ অবস্থান গ্রহণের আগে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, বাসের কন্ডিশন যাই হোক, কাগজপত্র ঠিক রাখার। মালিক সমিতির তথ্য, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সায়েদাবাদ টার্মিনালে চার শতাধিক পরিবহনের কাগজপত্র চেক করা হয়েছে। ৩০-৪০টির মতো গাড়িতে কাগজপত্র আপডেট পাওয়া যায়নি।

 ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘সকাল থেকে মহাখালী টার্মিনালে আমাদের প্রতিনিধিরা চেক শুরু করেছে। দুপুরের দিকে শুরু হয়েছে সায়েদাবাদ ও গুলিস্তানে। যেসব গাড়ির কাগজপত্র নেই সেসব মালিক তা আপডেট করে নিচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর