রবিবার, ১০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

উত্তেজনার ডাকসু ভোট কাল

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস, স্বস্তিতে নেই কোনো প্যানেলই

আকতারুজ্জামান ও নাসিমুল হুদা

উত্তেজনার ডাকসু ভোট কাল

প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল ক্যাম্পাসে সরব ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য ও ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামীকাল হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙে হতে যাওয়া এ নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সবার মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনের সব আনুষ্ঠানিকতাও প্রায় শেষ করে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার পরও শেষ মুহূর্তে এসে প্রস্তুতি ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর গতকাল শেষ দিনের মতো প্রচারণা চালিয়েছেন প্রার্থীরা। নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ।

কিন্তু শিক্ষার্থী, ভোটার ও প্রার্থীদের শঙ্কা এখন ভোট গ্রহণের বুথসংখ্যা নিয়ে। ডাকসু নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারসংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। এসব ভোটারের জন্য পর্যাপ্ত বুথ না থাকলে তারা ভোট দিতে পারবেন না। তাই বুথসংখ্যা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভোটারসহ প্রার্থীরাও। প্রতি ১০০ ভোটারের জন্য একটি বুথের দাবি করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। ডাকসু নির্বাচনে কোনো কোনো প্রার্থী বলছেন, নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনের তৎপরতা রহস্যজনক। তারা আসলে সুষ্ঠু নির্বাচন চান কিনা তা নিয়েই প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এ ছাড়া কোন পদ্ধতিতে কীভাবে ভোট দেবেন ভোটাররা, তাও পরিষ্কার করেনি প্রশাসন- এমন অভিযোগও প্রার্থীদের। প্রভোস্ট কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তে মিডিয়া সেন্সরের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ প্রার্থীদের। তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের জন্য অবাধ সুযোগ নিশ্চিতের দাবি তাদের। একই সঙ্গে আবাসিক হলগুলোয় পর্যাপ্ত ভোট গ্রহণের বুথ নিশ্চিতের দাবি জানান তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম সারওয়ার বলেন, ভোটাররা যেন স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পারেন তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ভোটার যেন ভোট দিতে এসে ফিরে না যান, এজন্য পর্যাপ্ত বুথের দাবি জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসূত্রে জানা যায়, গতকাল ভোট কেন্দ্র প্রস্তুতের জন্য ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে হল প্রশাসন। ভোট গ্রহণের জন্য হলগুলোয় শিক্ষার্থী অনুপাতে ১৫ থেকে ৫০টি পর্যন্ত বুথ স্থাপন করা হবে। গোপন ভোটকক্ষ বা বুথগুলো মূলত হলের মিলনায়তন, টিভিরুম ও ক্যান্টিনে স্থাপন করা হবে। তাই সেসব স্থানও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। ভোটকার্য পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য টেবিল-চেয়ার ও অন্যান্য সরঞ্জামও আনা হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ভোট গ্রহণেরর প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা শেষ মুহূর্তে এসে ভোট গ্রহণের জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তার সবই নিচ্ছি। আশা করি, যথাসময়ের মধ্যে সবরকমের প্রস্তুতি শেষ করতে পারব।’

এদিকে, নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। ক্যাম্পাসের সাতটি স্পটে তল্লশি চালাবে পুলিশ। স্পটগুলো হলো- শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী, জগন্নাথ হল ক্রসিং, রুমানা ভবন ক্রসিং, দোয়েল চত্বর ও শহীদুল্লাহ হল ক্রসিং। এসব স্পটে আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট ও অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ তল্লাশির বাইরে থাকবে। অবশ্য মেডিকেলগামী লোকজনদের বকশীবাজার, চানখাঁরপুল হয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’

নির্বাচন বিষয়ে শঙ্কা নিয়ে প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটাতে বিভিন্ন একাডেমিক ভবনে ভোটের দাবি জানিয়েছি। ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন তা গা করেনি। নির্বাচন উপলক্ষে প্রভোস্ট কমিটির সভার বৈঠকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সর আরোপ করা হয়েছে। এগুলো ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। কতটি বুথের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে তা এখনো পরিষ্কার করেনি প্রশাসন। ২১ হাজারের বেশি ভোটার আবাসিক হলের বাইরে অবস্থান করেন। তাই বুথসংখ্যা যদি পর্যাপ্ত না থাকে তবে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন না। এটি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ভোটাধিকার হরণের চেষ্টা করে তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তা প্রতিহত করবে।’

স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান বলেন, ‘যদি প্রয়োজনমাফিক বুথ দেওয়া না হয় তবে তা হবে রহস্যজনক। হলভেদে একজন ভোটারকে সর্বোচ্চ ৩৮টি ভোট দিতে হবে। কোনোভাবেই একজন ভোটার ৩ মিনিটের কম সময়ে ভোট সম্পন্ন করতে পারবেন না। তাই আমরা ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দেয়নি। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গোঁয়ার্তুমি ছাড়া কিছু নয়।’ আসিফুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনে কতটি বুথ হবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ভোটাররা। তারা সবাই ভোট দিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সংশয় কাজ করছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।’ প্রভোস্ট কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তে মিডিয়া সেন্সরের প্রতিবাদ জানান তিনি।

নির্বাচন সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যক্রম সন্দেহজনক আখ্যা দিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মো. নুরুল হক। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এই সহসভাপতি প্রার্থী মো. নুরুল হক গতকাল বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যক্রম সন্দেহজনক। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চান কিনা তা নিয়েই সন্দেহের উদ্রেক করেছে। প্রতি ১০০ ভোটারের জন্য একটি বুথের আয়োজন করতে চিফ রিটার্নি অফিসারের কাছে আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের জানিয়েছেন এটি নাকি তার এখতিয়ারে নেই। সব মিলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে আমরা দায়িত্ব এড়ানোর একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। কারণ, কীভাবে ভোট সম্পন্ন হবে তা প্রশাসন পরিষ্কার করেনি এখনো। ভোট গ্রহণের সময় না বাড়ানো রহস্যজনক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের হল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুথের তালিকা পাওয়ার পর নির্দিষ্ট করে জানানো যাবে কতটি বুথে এ ভোট নেওয়া হবে। আগামীকাল (আজ) এটি জানানো সম্ভব হবে।’

২৫ পদে ২২৯ প্রার্থী : প্রার্থী তালিকা অনুসারে, ডাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে লড়বেন মোট ২২৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২১, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৪ ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ১৩ জন। এ ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ১১, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ৯, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক ৯, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ১১, সাহিত্য সম্পাদক ৮, সংস্কৃতি সম্পাদক ১২, ক্রীড়া সম্পাদক ১১, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক ১০ ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৪ জন। পাশাপাশি ১৩টি সদস্য পদের বিপরীতে লড়বেন ৮৬ জন। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে যারা বাদ পড়েছিলেন তার মধ্যে যে পাঁচজন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছিলেন তারা সবাই প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।

সর্বশেষ খবর