রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কক্সবাজার এখনো থমথমে

একাধিক বিষয় সামনে রেখে সিনহা হত্যার তদন্ত, খতিয়ে দেখা হচ্ছে টেকনাফ পুলিশের কর্মকাণ্ড

সাখাওয়াত কাওসার ঢাকা, মুহাম্মদ সেলিম চট্টগ্রাম ও আয়ুবুল ইসলাম কক্সবাজার

মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা ঘটনার তথ্য বিকৃত করতে অনেকেই জড়িত ছিলেন। তাদের কেউ কেউ ভুল তথ্যের বৈধতা দিতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু শুরু থেকেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে কারিগরের ভূমিকায় ছিলেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন। তবে কী কারণে এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড? এটি কি পূর্বপরিকল্পিত, নাকি তাৎক্ষণিক? এর অনুসন্ধানসহ সার্বিক বিষয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সাবেক পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ গ্রেফতার হলেও এখনো টেকনাফের অধিবাসীদের মধ্যে কাটেনি ‘প্রদীপ ম্যানিয়া’। টেকনাফ থানায় প্রদীপ-অনুসারীরা এখনো বহাল তবিয়তে থাকায় আতঙ্কে রয়েছেন প্রদীপের হাতে নির্যাতিতদের অনেকে।

জানা গেছে, কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে চলছে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত। কোন স্বার্থে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে এসপি মাসুদ বিভিন্ন জায়গায় ভুল তথ্য দিয়েছেন? অন্যরাই বা কেন তার সঙ্গে শামিল হলেন? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে টেকনাফে দানবীয় রূপ ধারণ করা পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ গ্রেফতার হলেও এখনো ‘প্রদীপ ম্যানিয়ায়’ ভুগছেন অনেকে। তার নির্যাতনের শিকার অনেকের মধ্যেই এখনো বিরাজ করছে আতঙ্ক। ফলে ভুক্তভোগী লোকজন প্রদীপের নানা অপকর্ম নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। এরই মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের অপকর্ম ও বাণিজ্য নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে মামলার তদন্ত চলছে। আগামীকাল (রবিবার) গ্রেফতার হওয়া আসামিদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হচ্ছে। মামলার তদন্তে আসামি চিহ্নিত এবং খুনের মূল উদ্দেশ্য বের করাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

জানা যায়, মামলার এজাহারে চারটি গুলির কথা উল্লেখ করা হলেও সুরতহালে ছয়টি গুলির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে মেজর সিনহার শরীরে। প্রশ্ন উঠছে, প্রথম গুলি কিংবা দ্বিতীয় গুলিতে সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরও আরও চারটি গুলি করতে হলো কেন? মেজর সিনহা হত্যার মূল উদ্দেশ্য বের করার পাশাপাশি ‘আসল’ হোতাদের চিহ্নিত করার কাজও করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। একই সঙ্গে এ খুনের পেছনে কারও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য রয়েছে কি না তাও তদন্ত করা হচ্ছে। এ খুনের অন্যতম অভিযুক্ত প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলীর সঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের ফাঁস হওয়া ফোনালাপ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। ওই ফোনালাপের একটিতে শোনা যায়, ওসি প্রদীপ গুলির জন্য লিয়াকতকে নির্দেশের কথা স্বীকার করেন। অন্যটিতে শোনা যায়, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন ঘটনা সাজানোর পরামর্শ দেন অভিযুক্ত লিয়াকতকে। এ দুই ফোনালাপে কোথাও মাদকের কথা উল্লেখ করেননি পুলিশ কর্মকর্তারা।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ফাঁস হওয়া দুটি ফোনালাপ আমাদের নজরে এসেছে। তদন্তে ফোনালাপ দুটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

টেকনাফে এখনো প্রদীপ আতঙ্ক : স্থানীয়দের অভিযোগ, মেজর সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি প্রদীপ গ্রেফতার হলেও টেকনাফ থানার ‘টিম প্রদীপ’ হিসেবে পরিচিত পুলিশ সদস্যরা এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এ থানার টিম প্রদীপে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই বরখাস্ত ওসি প্রদীপ টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করতেন। একই সঙ্গে তারা সাজানো ইয়াবা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের একাধিক অধিবাসী জানান, প্রদীপ গ্রেফতার হলেও এখনো তার অনুসারীরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ফলে টেকনাফের লোকজনের আতঙ্ক কাটছে না। তাই প্রদীপ ম্যানিয়ায় ভুগছেন প্রদীপ ও তার অনুসারীদের হাতে নির্যাতিতরা।

প্রসঙ্গত, ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার সদরে যাওয়ার পথে বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট নয়জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এ ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব।

চার আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ : মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার চার আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)। গতকাল বেলা ২টার দিকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে তিনি পৌঁছান। নির্ধারিত প্রক্রিয়া শেষে বেলা আড়াইটা থেকে পুলিশের কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সাত দিনের রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্ত তিন আসামিকে আজ (রবিবার) র‌্যাব হেফাজতে নেওয়ার কথা রয়েছে। কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন জানিয়েছেন, বেলা দেড়টার দিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মেজর সিনহা হত্যা মামলার রিমান্ড-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র জেলা কারাগারে পৌঁছেছে। ফলে কারা-ফটকে র‌্যাব সদস্যরা চারজন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এ বিষয়ে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, চার আসামিকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ঘটনার ক্লু উদ্্ঘাটনের চেষ্টা করা হবে।

টেকনাফে নতুন ওসি : টেকনাফে নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন কুমিল্লার চান্দিনা থানার ওসি মো. আবুল ফয়সল। গতকাল চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিসের এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যোগদান করে টেকনাফ থানার দায়িত্ব নেবেন ফয়সল। প্রসঙ্গত, ৩১ জুলাই টেকনাফ বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে খুন হন মেজর সিনহা। ঘটনা তদন্তে ২ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর