সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মেধা পরিশ্রম সাফল্যে নারী

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মেধা পরিশ্রম সাফল্যে নারী

রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে গ্রামে-গঞ্জে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণে কঠোর পরিশ্রম করছেন বাংলার নারীরা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্রিমলাইনার ‘আকাশবীণা’ উড়িয়ে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছেন তারা। সীমান্ত সুরক্ষা থেকে শুরু করে রাজপথে শৃঙ্খলা আনতে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন  সাহসের সঙ্গে। মেধা, যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রমে বাংলার নারী এখন সাফল্যের শিখরে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে নারীদের জয়যাত্রা। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সরব উপস্থিতি নারীদের। এর মধ্য দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। করোনা মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বে নারী নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কমনওয়েলভুক্ত ৫৪ দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে শীর্ষ তিন নেতৃত্বে একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৪ মার্চ কমনওয়েলথ মহাসচিব পেট্রেসিয়া স্কটল্যান্ড কিউসি আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১ উপলক্ষে দেওয়া এক বিশেষ ঘোষণায় ‘অসাধারণ নারী নেতৃত্ব ও গভীর অনুপ্রেরণা’ হিসেবে অভিহিত করে করোনা মহামারী মোকাবিলায় নিজ নিজ দেশে তাঁদের সফল নেতৃত্বের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। নারীদের এ অগ্রযাত্রাকে উৎসাহিত করতে এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’। গত একযুগ ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করছেন নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে আট বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেগম রওশন এরশাদ এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী টানা একযুগ সংসদ উপনেতার দায়িত্বে রয়েছেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন হিসেবে চার দশক ধরে দায়িত্ব পালন করছেন বেগম খালেদা জিয়া।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গবিভাজন সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) ২০২০ অনুযায়ী, বিশ্বে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। এ সূচকে বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫০তম। প্রতিবেদনটি বলছে, এমনটা সম্ভব হয়েছে অর্থনৈতিক সুবিধা ও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায়। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়, বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে ৫০ বছরের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীরা দীর্ঘমেয়াদে নেতৃত্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে দেশটির মন্ত্রিসভায় মাত্র ৮ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ ৫০ দেশের তালিকায় থাকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। তবে নারীর মৌলিক অধিকার জোরদার করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনার উন্নতি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রজ তাদের ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ (২০১৫ সালে প্রকাশিত) বইয়ে লিখেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। ভারতে এ হার মাত্র ২৯ শতাংশ। তারা দেখিয়েছেন, নারীর স্বাক্ষরতা এবং শিক্ষায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণে নারীর অগ্রগামিতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা সূচক।

নারীর এ অগ্রযাত্রার বিষয়ে দেশের উচ্চ আদালতের প্রথম নারী বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতার পরিচয় দিয়ে উপযুক্ত অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছেন। দেশের নারী নেতৃত্ব গর্ব করার মতো। দেশের সরকারপ্রধান দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নারী। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার পদের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। নারীরা এখন আর পিছিয়ে পড়াদের দলে নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য আছে। এ জন্য নারীদের এগিয়ে আসতে হবে, সরব হতে হবে। বিচার বিভাগে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারক পদে নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৫৫০ জন নারী বিচারক পদে নিম্ন আদালতে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু উচ্চ আদালতে সে সংখ্যা এখনো বেশ কম। তাই আমাদের প্রত্যাশা, যোগ্যতার বিচারে আরও বেশিসংখ্যক নারীকে উচ্চ আদালতের বিচারকের দায়িত্ব দেওয়া হোক।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আছেন। তবে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা ১ শতাংশ বা তারও কম। দেশে সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৪টি। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩। ১৯৭৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল ৪ শতাংশ, এখন ৩৩ শতাংশ। অর্থনীতিতে দিন দিন নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ মতে, দেশে ৫ কোটি ৩১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রবাসে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পোশাকশিল্পে ৫ হাজারেরও অধিক কারখানায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত। যার ৮৫ শতাংশ নারী।

বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার প্রসার ও আর্থ-সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তথ্য প্রযুক্তি সেক্টরে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণের ফলে এখন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগে এই খাতে খুব কম নারী কাজ করতেন। তবে শীর্ষ পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম। প্রশাসনিক উচ্চ পদগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। নারীদের মধ্যে দক্ষ-যোগ্য মানুষের অভাব নেই। কিন্তু এ জন্য দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি।’ সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নারীরা এগিয়ে আসছেন এ পেশায়। এর ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ, দায়িত্বশীল পেশায়ও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ পেশায় আসতে নারীকে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। ১০ বছর আগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা শহরে কর্মরত দেড় হাজার সাংবাদিকের মধ্যে মাত্র ৬০ জন ছিলেন নারী। অর্থাৎ মোট সাংবাদিকের ৪ শতাংশ। তবে টেলিভিশন চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকা বৃদ্ধির কারণে এ সংখ্যা বর্তমানে বেড়েছে।

এ ব্যাপারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রথম নারী সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘৩৫ বছর আগে যখন সংবাদপত্রে কাজ শুরু করি তখন নারীদের অংশগ্রহণ ছিল হাতে গোনা। তারাও ডেস্কে কাজ করতেন। রিপোর্টিংয়ে নারীরা তেমন একটা আসতেন না। কিন্তু দেশে টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের বিকাশে গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং কাজে মাঠে থেকে গণমাধ্যমে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছেন নারীরা। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর সংখ্যা এখনো নগণ্য। তিনি আরও বলেন, নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও কাজের পরিবেশে গুণগত পরিবর্তন হয়নি। নারীদের অবস্থানকে এগিয়ে নিতে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। নারীদের এখনো অনেক পথ যেতে হবে।’ চিকিৎসা, শিক্ষা ও সেবার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ২২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। তার মধ্যে ১৩৬ জন ছাত্রী, ছাত্র মাত্র ৮৪ জন। আবার ১০ বছরে পুরুষের তুলনায় এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনকারী নারীর সংখ্যাও প্রায় ৩ হাজার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে মেডিকেল কলেজগুলোয় ১০ হাজার ২২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। তার প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্রী। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে সশস্ত্র বাহিনীতে। নারীরা বেছে নিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। জীবন বাজি রেখে কাজ করছে দেশের জন্য। নির্ভুল নিশানায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে শত্রুপক্ষের মেরুদ । আবার মমতাময়ী মায়ের মতো গড়ে তুলছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন আইভরি কোস্ট ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মেডিকেল কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা প্রথম বাংলাদেশি নারী কর্নেল নাজমা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রথম নারী হিসেবে মিশনে মেডিকেল কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। প্রত্যন্ত জনমানবহীন গ্রামে অনেক সময় ভারী অস্ত্র ছাড়াই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাদের। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নারীরা পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে কম তো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। আর এর সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তো আছেই। নাজমা বেগম পরপর দুবার দুটি দেশে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ও কান্ট্রি সিনিয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ ও বিশ্বের ইতিহাসে এ এক নতুন অর্জন। পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় এবং অনেক সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা পার করে কাজ করে চলেছে নারীরা। নিজের শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নারীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।

সর্বশেষ খবর