রবিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ১৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার প্রস্তুতি

আসামি হবেন প্রায় ৭০ জন

আনিস রহমান

বিদেশে পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বিরুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুটের তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এ ব্যাপারে আরও দুই ডজন মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে সংস্থাটি। এ মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা ৭০ হবে বলে জানিয়েছেন অনুসন্ধানকারী দলের একাধিক কর্মকর্তা।

এ ছাড়া পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলা অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক।

অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা জানান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের প্রায় ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জালিয়াতিপূূর্ণ ঋণ প্রদানের রেকর্ড পেয়েছে দুদক। আরবি এন্টারপ্রাইজ, জি অ্যান্ড জি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড করপোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ প্রায় ২০টির মতো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে এ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। পি কে হালদার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রায় ৭০ জনকে আসামি করে আরও দুই ডজন মামলা হতে পারে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।

অনুসন্ধান কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে এফএএস ফাইন্যান্সের রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন। গত পাঁচ বছরে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সের দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল কেন উদ্ঘাটন করতে পারল না, গত পাঁচ বছরের এ-সংক্রান্ত পরিদর্শন প্রতিবেদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে দুদকের পরিচালক বেনজীর আহম্মেদ স্বাক্ষরিত একটি পত্র দেওয়া হয়েছে। কারও ইচ্ছাকৃত গাফিলতি বা কুমতলব উদ্ঘাটন হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্রে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুট করে, একই মালিকানাধীন আরও প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় আরও প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে। এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি, পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেও চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের কর্মকর্তারা জানান, পি কে হালদারের মামলা অনুসন্ধান করতে গিয়ে হিন্দি ছবি ‘পি কে’র কথা মনে পড়ে। পি কে ছিল এক সাংকেতিক নাম আসলে ভিনগ্রহের এলিয়েন। তেমনি পি কে হালদার হলেন একটি অশনিসংকেত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটের মূল পরিকল্পনাকারী ও সুবিধাভোগী। সামান্য একজন কর্মচারী হয়ে কীভাবে কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া যায় তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

পি কে হালদারের বিস্ময়কর উত্থান দুই বছর আগে সবারই অজানা ছিল। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে প্রথমে তার নাম আসে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে যখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় তখন হঠাৎ দুদকে ৬০-৬৫ জনের নামের তালিকা দিয়ে একটি অনুসন্ধান শুরু হয়। একটি সাদা কাগজে ৬০-৬৫ জনের শুধু নাম ছিল। কার কী পরিচয়, পদবি, ঠিকানা বা কী অপরাধ কিছুই বর্ণনা ছিল না। প্রাথমিকভাবে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। কিছু দিন পর ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর আরও দুজন কর্মকর্তাকে টিমে সংযুক্ত করা হয়।

টিম পুনর্গঠন হওয়ার পর ওই দিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে ২৪ জনের ইমিগ্রেশনে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের পত্র দেওয়া হয়। ইমিগ্রেশন অথরিটি ২৩ অক্টোবর সকালে তা গ্রহণ করেন এবং ইমিগ্রেশন বিষয়ে দুদকের ফোকাল পয়েন্ট পরিচালক (পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন) তার মোবাইল ফোনের হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে বেলা পৌনে ৩টায় ইমিগ্রেশনে তা পাঠান এবং তারা সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণ করেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনের তথ্যানুযায়ী পি কে হালদার ২৩ অক্টোবর বিকাল ৪টার দিকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। অর্থাৎ দুদক হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ দেওয়ারও ঘণ্টাখানেক পর ইমিগ্রেশন ক্রস করেন। তা ছাড়া একসঙ্গে ২৪ জনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিল। পি কে হালদার আসলে কে, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তখন পর্যন্ত দুদক জানত না, কারণ শুধু পি কে হালদার একটি নাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শুধু তথ্য সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে ইমিগ্রেশনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।

আরেক টিমের কাছে ২৪ অক্টোবর লিখিতভাবে অভিযোগ এলে সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে/বিএফআইইউর কাছে তথ্য চেয়ে পত্র দেয় দুদক। সে পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ টিম গঠন করে এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করে। বিএফআইইউ সে প্রতিবেদন ২০২০ সালের ৭ জুলাই দুদকের ডিজি, মানি লন্ডারিংয়ের কাছে পাঠায়। বিএফআইইউর প্রতিবেদন পাওয়ার পরই দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮৩ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেন এবং পর্যায়ক্রমে ৫২ জনের বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। ইতিমধ্যে পিপলস লিজিংয়ের প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচটি মামলা হয়েছে, যেখানে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান, পরিচালক সামসুল আরেফিন আলামিনসহ প্রায় ৫০ জনকে আসামি করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতে ১৫টি মামলা হয়েছে, যেখানে পি কে হালদারসহ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, বাসুদেব ব্যানার্জি, নওশেরুল ইসলামসহ ১০ জন পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীসহ প্রায় ৭০ জন আসামি হয়েছেন। পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় এ পর্যন্ত দুদক পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান, পি কের দুই প্রেমিকা অবন্তিকা বড়াল, নাহিদা রুনাইসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ছয়জন দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। দুদক এ পর্যন্ত পি কে হালদারের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ ও ক্রোক করেছে।

সর্বশেষ খবর