বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
জাতীয় সংসদে বাজেট পাস

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে হইচই

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ না হওয়ার বিষয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্যদের অভিযোগ অস্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মাস্ক নিয়ে কথা বলছেন। মাস্ক তো কেনাই হয়নি। তার পেমেন্ট দেওয়া হয়নি। ঢালাও অভিযোগ দেওয়া অগ্রহণযোগ্য। এ সময় বিরোধী দলের এমপিরা সমবেতভাবে মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। সংসদের এই হইচই ও হট্টগোলের মাঝে একপর্যায়ে তিনি বক্তব্য থামিয়ে দেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বিরোধীদলীয় এমপিদের বাধার মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর আগে জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টাকা খরচ করতে পারেনি। ফেরত দিয়েছিল। খরচ করতে না পারলে ৩৫০ জন এমপিকে ভাগ করে দেন। আমরা খরচ করি। স্বাস্থ্যসেবা আমরা দেখব। আপনাদের দরকার নেই। ডাক্তার-নার্স নিয়োগ করতে পারছেন না। এমপিদের দায়িত্ব দেন। আমরা নিয়োগের ব্যবস্থা করি।

পীর ফজলুর রহমান বলেন, আমার এলাকার হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স নেই, ডাক্তার কবে পাব? এক্স-রে মেশিন কবে পাব? স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যতবার বলি, উনি ডিও লেটার দিতে বলেন। কতবার ডিও দিলে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে মেশিন পাব?

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, স্বাস্থ্য খাত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি দূর করতে হলে ডালপালা কেটে লাভ নেই। গাছের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বিএনপির ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অনিময় তুলে ধরে বলেন, এই যে বরাদ্দ দিচ্ছি সেটা কোথায় যাচ্ছে? বরাদ্দ খরচ করার সক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের আছে কি না, সেই প্রশ্ন চলে আসছে। জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী, মুজিবুল হক চুন্নু ও বিএনপির  মোশাররফ হোসেনও স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম তুলে ধরেন। পরে জবাব দিতে উঠে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিরোধী দলের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, হাসপাতালে বেহাল অবস্থার দায় এমপিদের ওপরও বর্তায়। সব এমপি তো হাসপাতালের চেয়ার (চেয়ারম্যান)। আপনারা প্রত্যেকে দায়িত্বে আছেন। এই বিষয়গুলো আপনাদেরই দেখার কথা। নার্স, ডাক্তার বা যন্ত্রপাতি লাগলে তো আপনাদেরই বলতে হবে। শুধু অভিযোগ দিলে তো হবে না। যা যা প্রয়োজন আছে তার ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে ঢালাওভাবে বললে গ্রহণযোগ্য হবে না। সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে?’ তিনি বলেন, মাস্কের কথা বলছেন, সেই মাস্ক কোনোদিনই কেনা হয়নি। পেমেন্ট করা হয়নি। রিসিভ করা হয়নি। কিন্তু মাস্কের কথা আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের এ পর্যায়েই বিরোধী দলের এমপিদের চিৎকার করে তীব্র আপত্তি জানাতে দেখা যায়। এ সময় শোরগোলের সৃষ্টি হয়।স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী বছরের প্রথম কোয়ার্টারের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ কোটি ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা রয়েছে। এটা দিয়ে আমরা ৫ কোটি মানুষকে টিকা দিতে পারব। জনসন অ্যান্ড জনসনকে রিসেন্টলি অনুমতি দিয়েছি, সেখানকার ৭ কোটি ভ্যাকসিন দিয়ে ৭ কোটি মানুষকে টিকা দিতে পারব। তিনি বলেন, এই করোনার মধ্যেও আমরা চিকিৎসক, নার্সসহ ২০ হাজার লোক নিয়োগ দিয়েছি। টেকনিশিয়ান নিয়োগ চলমান রয়েছে।

সংসদে বাজেট পাস : জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। এটি চলমান মহামারী করোনাকালেরও দ্বিতীয় বাজেট। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কমসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে ২ জুন শুরু হয় বাজেট অধিবেশন। চলে গতকাল পর্যন্ত। এ সময় অধিবেশন মুলতবি করে বিরতিই থাকে অন্তত ২৩ দিন। গতকাল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট পাসের জন্য বেলা ১১টায় অধিবেশন শুরু হয়। পরে ২০২১-২২ অর্থবছরের এ বাজেট কণ্ঠভোটে পাস করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অনুমোদনের পর ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার থেকেই কার্যকর হবে এ বাজেট। ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার এ বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর অধিবেশনজুড়ে এর ওপর সাধারণ আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। তবে মহামারীর কারণে গতবারের মতো এবারও বাজেটের ওপর আলোচনা হয়েছে সীমিত আকারে। এজন্য মাত্র দুই দিন আলোচনা করেই চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়। সপ্তাহখানেক বিরতি দিয়ে টানা চার দিন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা চলে। এরপর আরও ১০ দিন বিরতি দিয়ে মঙ্গল ও বুধবার দুই দিন বাজেটের ওপর আলোচনা করা হয়। সব মিলিয়ে শতাধিক সংসদ সদস্য এবার বাজেটের ওপর আলোচনা করেন। সম্পূরক বাজেটসহ বাজেটের ওপর মোট ছয় দিনে ১৫ ঘণ্টার মতো আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। এর আগে গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেট অধিবেশন হয়েছিল। নয় দিনের ওই বাজেট অধিবেশনে ১৮ জন সংসদ সদস্য ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট আলোচনা করেছিলেন। সাধারণত বাজেট অধিবেশন দীর্ঘ হয়। অধিবেশনে সম্পূরক বাজেটের ওপর দুই থেকে চার দিন এবং সাধারণ বাজেটের ওপর ১২ থেকে ১৫ দিন আলোচনা হয়। বাজেট নিয়ে ৫০ থেকে শুরু করে ৬৫ ঘণ্টার মতো আলোচনারও রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এ বছর করোনা সংক্রমণ রোধে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন কম আলোচনার রেকর্ড হলো।

এর আগে কয়েকজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার সংসদে অর্থবিল পাস হয়। অর্থবিলে বিনা প্রশ্নে নতুন শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বুধবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনের শুরুতেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মঞ্জুরি দাবিতে আলোচনা করার কথা জানান। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এসব দাবিতে আলোচনা করেন। এরপর বাজেটটি পাসের জন্য ভোটে দেওয়া হয়। পরে কণ্ঠভোটে পাস করা হয় আগামী অর্থবছরের বাজেট। এ সময় সরকারদলীয় সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও অভিবাদন জানান।

নির্দিষ্টকরণ বিল পাস : আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে মোট ৭ লাখ ৯২ হাজার ৯১২ কোটি ৯৫ লাখ ৯ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। এর মধ্যে সংসদ সদস্যদের ভোটে গৃহীত অর্থের পরিমাণ ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩২ কোটি ৭১ লাখ ৯ হাজার এবং সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সংযুক্ত তহবিলের দায়ের মধ্যে ট্রেজারি বিলের দায় পরিশোধ, হাই কোর্টের বিচারপতি ও মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বেতনও অন্তর্ভুক্ত।

মঞ্জুরি দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব : আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির ১২ জন সংসদ সদস্য ৬২৫টি বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। এর মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বিরোধী দলের আলোচনার পর সব প্রস্তাব কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়।

ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো আনেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লিয়াকত হোসেন খোকা, রুস্তম আলী ফরাজী, রওশন আরা মান্নান, বিএনপির হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা, মোশাররফ হোসেন ও গণফোরামের মোকাব্বির খান। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবি সংসদে তোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক নজরে নতুন বাজেট : নতুন অর্থবছরের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অঙ্ক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। বিদায়ী অর্থবছরে মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১৯ শতাংশের বেশি। দুই বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি না থাকায় রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রীর আশা, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন মুস্তফা কামাল। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। টাকার ওই অঙ্ক মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশের মতো। গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এ অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ শতাংশের মতো বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

মহামারীর মধ্যেই বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা দুই দফা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর