সোমবার, ২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
কৃষক লীগের রক্তদান কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়া মোশতাকের ইন্ধন ছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়া মোশতাকের ইন্ধন ছিল

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকের ইন্ধন ছিল।

রক্তাক্ত-শোকাবহ শোকের মাস আগস্টের প্রথম দিন গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্ন এলাকায় কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্ত ও প্লাজমা দান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। 

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, এদেশীয় কিছু পাকিস্তানি দালাল চক্র, তাদের তোষামোদী-খোষামোদী পদলেহনকারী কিছু গোষ্ঠী কেন জানি বাঙালির অভ্যুদয়, বাঙালির এই বিজয়কে কখনই মেনে নিতে পারেনি। দুঃখজনক হলো যে, নিজের দলের ভিতর খন্দকার মোশতাক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আবার অনেকেই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এ ঘটনা ঘটাতে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই উচ্চ পর্যায়ে যদি কেউ না থাকে তাহলে এটি কখনো সম্ভব ছিল না। আর উচ্চ পর্যায়ে তাদের সঙ্গে কে ছিল সেটি তো কর্নেল ফারুক-রশিদ বিবিসিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিল, সেই সাক্ষাৎকারে তারা বিস্তারিত বলেছিল। তারা বলেছিল, জিয়াউর রহমান উপ-সেনাপ্রধান ছিল। তার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল, সম্পর্ক ছিল এবং সফল হতে পারলে সে তাদের পাশে থাকবে এই কথা দিয়েছিল। কাজেই মোশতাক-জিয়ার যে সখ্যতা এবং তাদের যে এই কাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততা, এটা তো স্পষ্ট। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা সেটা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে সেটা একদিন না একদিন আবিষ্কার হবে এটা ঠিক। ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটাও একদিন বের হবে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। তাঁর  (জাতির পিতার) রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, দেশের উন্নয়ন করাটাকেই সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। তাই পেছনে কে ষড়যন্ত্র করেছে, কী করেছে, সেদিকে না গিয়ে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে এই ক্ষুধার্ত, দরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করে তাদের জীবনমান উন্নত করা। 

আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাবা-মা, ভাই সবাইকে হারিয়েছি। তবুও একটা আদর্শকে ধারণ করেই পথ চলি। এটাই আমার শক্তি। যে স্বপ্নটা আমার বাবা দেখেছিলেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর মুখে যে কথাগুলো শুনেছি, সেটাকে আমার বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বাইরে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাই, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দেখতে চাই। বাংলাদেশ ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে, বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে, মর্যাদা নিয়ে চলবে, সম্মানের সঙ্গে চলবে। আমরা বিজয়ী জাতি, বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে, এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’ উদ্ধৃতি তুলে ধরে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, রক্ত জাতির পিতাও দিয়ে গেছেন। কারণ, যখন এ দেশের মানুষকে তিনি মুক্ত করেছেন। তখন যারা স্বাধীনতাবিরোধী বা যারা বিজয় চায়নি তারা তাঁকে হত্যা করেছে। দুঃখজনক হলো, নিজের দলের ভিতরে খন্দকার মোশতাক যেমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, আবার অনেকেরই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আর এই ঘটনা ঘটাতে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ে যদি তাদের পক্ষে কেউ না থাকে এটা কখনো সম্ভব ছিল না।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন পাকিস্তানের অনেক চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ তাদের কাছে একটা বোঝা ছিল। কারণ এই বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেশি, ক্ষুধার্ত মানুষ আর বাংলাদেশ সব দিক দিয়ে অনগ্রসর। কাজেই এটা নাকি পাকিস্তানের জন্য বোঝা! এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানিরা ভুলে গিয়েছিল যে তাদের যতটুকু উন্নয়ন তার অর্থ জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ। কারণ একমাত্র বাংলাদেশ থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো, বাংলাদেশ থেকেই সবকিছু যেত এবং সেটা নিয়ে তারা নিজেদের উন্নত করে। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা সেই দরিদ্র রেখে যায়। বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখে যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেকে এই ধরনের মতামত দিয়েছিল যে, এটা আমাদের জন্য একটা বোঝা ছিল, চলে গেছে ভালোই হয়েছে। এরা (বাংলাদেশের মানুষ) তো আর কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পাকিস্তানি সেই সমস্ত লোক তাদের যে মতামত, আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা, কার্যক্রম যদি পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখবেন সব একই, তাদের মধ্যে মিলে যায়। তারাও ভেবেছিল এই বাংলাদেশ কোনো দিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ার কোনো পথ ছিল না। উপরন্তু খুনিদের পুরস্কার হিসেবে জিয়াউর রহমান তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়। তিনি বলেন, জিয়ার পথ ধরে জেনারেল এরশাদ এই খুনিদের রাজনীতি করার, রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এমনকি ভোট চুরি করে পার্লামেন্টেরও মেম্বার করে। তা থেকে একধাপ ওপরে গিয়ে খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনে ভোট চুরি করে খুনি রশিদকে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতার চেয়ারে বসায় এবং আরেক খুনিকে পার্লামেন্টে মেম্বার করে তাদের পুরস্কৃত করে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ হয় জঙ্গিদের দেশ, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। দেশটাই ভিক্ষার ঝুড়ি হাতে নিয়ে নামে। ’৯৬ সালে ২১ বছর পর সরকারে এসে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের মাধ্যমে তাঁর সরকার এই হত্যাকান্ডের বিচারের সমস্ত বাধা দূর করে বিচার কাজ শুরু করে এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর সেই বিচার সম্পন্ন করতে সমর্থ হয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ’৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচারের রায় ঘোষণার দিনেও হরতাল ডেকে সে সময় বিরোধী দলে থাকা খালেদা জিয়া বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। যদিও সেই বিচারের রায় হয়েছিল এবং তাঁর সরকার দুজন খুনিকে আমেরিকা ও থাইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু পুনরায় খালেদা জিয়া ২০০১ সালে সরকারে এসে সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে আবারও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। তিনি বলেন, এমনকি, ৩ নভেম্বর যখন বিচারের রায় ঘোষণার তারিখ সুনির্দিষ্ট করা হয়, তারপরও এক খুনিকে খালেদা জিয়া চাকরি ফিরিয়ে দেয় এবং প্রমোশন দেয় এবং পরবর্তীতে তাকে দূতাবাসেও চাকরি দেয়। কারণ, প্রমোশন দিয়ে খালেদা জিয়া মনে হয় এটাই দেখাতে চেয়েছে যে, এই খুনিদের বিচার করা যাবে না।

একজন খুনি মৃত্যুবরণ করেছিল সেই মৃত ব্যক্তিকেও খালেদা জিয়া প্রমোশন দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ডিসমিস করেছিল, তাই অবসর ভাতা দিয়েও তাকে পুরস্কৃত করে খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময় জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল, সেই ভাষণও আজ বিশ্বের সবচেয়ে উদ্বুদ্ধকারী একটি ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর জাতির পিতার অগাধ বিশ্বাসের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট যখন খবরটা পাই আমরা কিছুতেই তা বিশ্বাস বা ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশের মানুষের ওপর আমার বাবার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন, বাঙালি কখনো তার গায়ে হাত দিতে পারবে না। আর পাকিস্তানিরা যখন চেষ্টা করে তাঁকে হত্যা করতে পারেনি, আর বাঙালিরা কেন মারবে? অনেকেই অনেকভাবে বঙ্গবন্ধুকে খবর দিয়েছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি। তিনি (বঙ্গবন্ধু) একটা কথাই বলেছেন, এরা আমার সন্তানের মতো। এরা কেন আমাকে মারবে? জাতির পিতার সেই বিশ্বাসে চরম আঘাত দিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সরকার গঠন করলাম। তখন থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা ছিল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা যে রূপকল্প দিয়েছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করব। আজকে বাংলাদেশে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি। এখন জাতির পিতার ১০১তম জন্মবার্ষিকী। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের যে উন্নয়নের গতিধারা, এটা  হয়তো আমরা আরও অব্যাহত রাখতে পারতাম। যদিও করোনা নামক মহামারী না দেখা দিত। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শোক দিবসের কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনায় শুধু আমাদের না, বিশ্বব্যাপী আজ অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। তবুও আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। করোনার ভয়াল থাবা সত্ত্বেও মানুষের খাদ্যের এবং তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা সরকার করে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির সাফল্য কামনা করে বলেন, এই রক্তদানের মাধ্যমে আমরা একজন মুমূর্ষু রোগীকেও যদি বাঁচাতে পারি, সেটাই হবে সব থেকে বড় কথা। কেননা মানব কল্যাণে আপনি রক্তদান করছেন। জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, যে আদর্শের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, বঙ্গবন্ধু তো এটাই চেয়েছিলেন যে, তাঁর দল (আওয়ামী লীগ) মানুষের পাশে থাকবে, দুর্যোগে মানুষের সঙ্গে থাকবে, মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে সেই কাজটিই করে যাচ্ছে।

কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দের সভাপতিত্বে ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী প্রমুখ।

অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বেগম মতিয়া চৌধুরী দুস্থ কৃষকদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন এবং শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর