বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জামিন জালিয়াতির হোতা তিন কারা কর্মকর্তা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন

উবায়দুল্লাহ বাদল

মাগুরা জেলা কারাগারে জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদি মুক্তির ঘটনায় তৎকালীন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। সিনিয়র জেল সুপার আলী আকবর তালুকদার, জেলার মো. জাকের হোসেন ও ডেপুটি জেলার মাসুদুর রহমান সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচলিত বিধিবিধান ও রেওয়াজ লঙ্ঘন করেই তিন আসামি আবু বকর, গোলাম মোস্তফা ও জালালউদ্দিনকে মুক্তি দেন। এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত জামিননামার সঠিকতা যাচাই না করেই খুব দ্রুতগতিতে এ কাজ সম্পন্ন করেন তারা। ২০০৪ সালের এ ঘটনায় এ তিন কারা কর্মকর্তার সরাসরি যোগসাজশ ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনের আলোকে ২৬ সেপ্টেম্বর ঘটনায় দায়ী হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার জাকের হোসেনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই ঘটনার ১৭ বছর পর তিনি বরখাস্ত হলেন। এখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা শুরু করবে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। তবে ওই ঘটনায় যশোর কারাগারের তৎকালীন সিনিয়র জেল সুপার আলী আকবর তালুকদার ও ডেপুটি জেলার মাসুদুর রহমান মারা গেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে মাগুরা জেলা কারাগারে জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মুক্তির ঘটনায় হাই কোর্টের নির্দেশে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। ৪ আগস্ট গঠিত ওই কমিটির প্রধান করা হয় সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব নাসরিন জাহানকে। অন্য দুই সদস্য হলেন আইন ও সলিসিটর বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুম ও মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আমিনুল ইসলাম। কমিটি দীর্ঘদিন সরেজমিন তদন্তের পর সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে গত সপ্তাহে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের দফতরে প্রতিবেদন জমা দেয়। এদিকে বিষয়টি হাই কোর্টকে অবহিত করতে চিঠি দিয়েছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এতে বলা হয়েছে- মাগুরা জেলা কারাগারে জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে তিন আসামি জামিনে মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ৮৮৩/২০০৩, তারিখ ০৮.০৩.২০২১ আদেশ মোতাবেক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তৎকালীন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আলী আকবর তালুকদার, জেলার মো. জাকের হোসেন ও ডেপুটি জেলার মাসুদুর রহমানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, এ তিন কর্মকর্তার মধ্যে সিনিয়র জেল সুপার আলী আকবর তালুকদার ও ডেপুটি জেলার মাসুদুর রহমান ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্য কর্মকর্তা তৎকালীন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. জাকের হোসেন বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে জেল সুপার পদে কর্মরত। সাময়িক বরখাস্তসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আদেশ দিয়েছেন।

এর পরই সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা-১ শাখার উপসচিব তাহনিয়া রহমান চৌধুরীর স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- যশোর জেলা কারাগার থেকে জাল জামিন ব্যবহার করে তিন আসামি বের হওয়ার ঘটনায় হাই কোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপিল আদেশ মোতাবেক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে জাকের হোসেনকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকালীন তিনি আর্থিক বিধিবিধান মোতাবেক খোরাকি ভাতা পাবেন। কারাগারসূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৬ জুলাই জাকের হোসেন জেল সুপার হিসেবে হবিগঞ্জে যোগদান করেন।

যেভাবে ঘটনা প্রকাশ পায় : সূত্র জানান, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাগুরার শালিখা থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯(১)(খ) ধারায় করা মামলায় আসামি গোলাম মোস্তফা, আবু বকর ও জালালউদ্দিনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে মাগুরার আদালত। দন্ডিত তিন আসামিকে ২০০৩ সালের ৪ মার্চ প্রথমে মাগুরা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ওই বছরের ৮ মার্চ পাঠানো হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই কারাগারে থাকা অবস্থায় সাজার বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন আসামিরা। কিন্তু ওই আপিল শুনানি না করেই হাই কোর্টের জাল জামিনাদেশ সৃজন করেন আসামিরা। এরপর তা নিম্ন আদালত হয়ে যায় কারাগারে। ওই জাল জামিনাদেশের কপি পেয়ে ২০০৪ সালের ১৮ এপ্রিল দন্ডিত তিন আসামিকে মুক্তি দেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আবারও হেরোইন পাচারে জড়ান আসামিরা। ১ কেজি হেরোইন পাচারের একটি মামলা বিচারাধীন ছিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ। এ মামলায় ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল হাজিরা দেন গোলাম মোস্তফা। তখন তিনি আদালতে বলেন, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় তিনি দন্ডিত হয়ে হাই কোর্টের জামিনে আছেন। কিন্তু কোনো কাগজ দাখিল করতে পারেননি। এর পরই তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে ২০০৩ সালে দায়ের করা আপিলে হাই কোর্টে জামিন চান। তখন জাল জামিনাদেশ সৃজন করে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ পায়। এর পরই বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ৮ মার্চ বিষয়টি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পরই জালিয়াতির প্রমাণ পায় তদন্ত সংস্থাটি। এ ছাড়া গত এপ্রিলে জালালউদ্দিন ও আবু বকরকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সর্বশেষ খবর