রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপির প্রতীকী গণঅনশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী বৃদ্ধির পেছনে ক্ষমতাসীনদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করে এর ব্যর্থতার দায় নিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন,   রবিবার (আজ) থেকে রোজা। কিন্তু সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা আর লোভের কারণে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টিকারী আওয়ামী লীগকে সরাতে না পারলে জনগণ স্বস্তি পাবে না। ‘দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদে’ গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির প্রতীকী অনশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সরকার ব্যর্থ হয়েছে জনগণকে স্বস্তি দিতে। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, অনতিবিলম্বে দ্রব্যমূল্য কমান। নইলে জনগণ আর চুপ করে বসে থাকবে না। তারা রাজপথে নেমে এসেছে। এই ব্যর্থ সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরে যাবে না।

বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে এ অনশন শুরু হয় সকাল ১০টায়। বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে পানি পান করিয়ে অনশন ভঙ্গ করান। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ব্যানার-ফেস্টুনসহ খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানার নেতা-কর্মীরা কর্মসূচিতে যোগ দেন। মহানগরসহ অঙ্গ-সংগঠনের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফুটপাথ ও রাস্তায় পলিথিন এবং মাদুর বিছিয়ে অনশনে অংশ নেন। বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে অনশনস্থল সমাবেশে পরিণত হয়।

তারা পণ্যের দাম কমানো এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিসহ বিভিন্ন স্লোগানে সমগ্র এলাকা মুখরিত করে তোলেন। এদিকে অনশন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মৎস্য ভবন, কদম ফোয়ারা, পল্টনসহ জাতীয় প্রেস ক্লাবের আশপাশে অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। অনশনের শুরুতে মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকারকে পরাজিত করতে হবে। এই সরকারকে জানাতে হবে, তাদের ওপর জনগণের আস্থা নেই। ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্যর্থতায় দায় স্বীকার করে সরে যান। ক্ষমতা ছেড়ে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। তিনি বলেন, দলের বহু নেতা-কর্মীকে আটক রাখা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় আটক করে রাখা হয়েছে। সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মুক্তির দাবি করেন তিনি।

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সব কথার এক কথা সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সবার এক কথা সুষ্ঠু নির্বাচন, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। তিনি বলেন, এখন জাতীয় সরকার- কেউ আগে কেউ পরে চায়- এই তর্কেরও বোধহয় প্রয়োজন নাই। কারণ আগে এই সরকারকে বিতাড়িত করি। হাসিনা সরকারকে সরাতে না পারলে যে ধরনের সরকারই চান, তার কোনোটাই হবে না। তাই আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই সরকারের দাফন করি। তারপর সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করি, দেশটা মেরামত করি। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, লগি-বৈঠা আমাদের অস্ত্র নয়। এই অস্ত্রের প্রয়োজন আছে আজকে যারা সরকার চালায় তাদের। বিএনপির অস্ত্র হচ্ছে জনগণ। এই জনগণকে নিয়ে আমরা এ সরকারের পতন ঘটিয়ে এ দেশে জনগণের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব।

পাঁচ ঘণ্টা অনশন কর্মসূচিতে শতাধিক নেতার বক্তব্যের কারণে নির্ধারিত সময় বেলা ৩টা পেরিয়ে যাওয়ায় সমাপনীতে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বক্তব্য না দিয়ে অনশনের সমাপ্তি টানেন।

বিএনপির ‘জাতীয় সরকারের ধারণায়’ জোটের শরিকদের সমর্থন : এদিকে বিএনপির অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে বিএনপি জাতীয় সরকারের যে ধারণা দিয়েছে তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ২০-দলীয় জোটের শরিকরা।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের লুটপাটের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে এসেছি। দেশের মানুষ সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর জন্য ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশপ্রেমিক, ইসলামী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে লাভ নেই। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের যে ধারণা দেওয়া হয়েছে আমরা তা সমর্থন করছি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এর বিকল্প নেই। বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরেই জাতীয় সরকার হবে। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সভাপতি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।

নির্বাচনের আগে নয়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর তারেক রহমান জাতীয় সরকারের যে ধারণা দিয়েছেন আমরা তা পূর্ণাঙ্গভাবে সমর্থন করি।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে গদিচ্যুত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। আন্দোলনের প্রতি আমরা সমর্থন করছি।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে সরকার যাতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং পালানোর কোনো পথ না পায়। মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। যদি জনগণের জন্য আন্দোলন করি, ন্যায্য আন্দোলন করি, মানুষের কাছে যাব, মানুষের সঙ্গে বসব, কথা বলব। ডাক দেবেন, সারা বাংলাদেশ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে ওদের ক্ষমতার আস্ফালন, পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। সব গণতান্ত্রিক দলগুলোকে এক হয়ে সরকার পদত্যাগের আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।

তিন জামায়াত কর্মীকে মারধর : এদিকে অনশন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলকে সামনে বসাতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন দলটির তিনজন নেতা-কর্মী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের একজন নেতা বলেন, বিএনপির অনশনে যোগ দেওয়া নূরুল ইসলাম বুলবুলকে আমরা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সামনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে বেশ ভিড় ছিল। তাই ফুটপাথে রাখা চেয়ারে তাকে (নূরুল ইসলাম বুলবুল) বসার ব্যবস্থার অনুরোধ করে সামনে যেতেই হঠাৎ সেখানে থাকা যুবদলের লোকজন হামলা করেন। এতে আমাদের তিনজন আহত হয়েছেন। তবে এ বিষয়ে যুবদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ভুল বোঝাবুঝির কারণে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, যা পরে সমাধান হয়েছে।

বিএনপি মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব আমিনুল হকের পরিচালনায় অনশনে আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খান, আবদুস সালাম, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, কামরুজ্জামান রতন, মীর সরাফত আলী সপু, তাইফুল ইসলাম টিপু, আবদুস সালাম আজাদ, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, আবু নাসের মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহ, রাজিব আহসান, আকরামুল হাসান, মহানগরের ইশরাক হোসেন, নবী উল্লাহ নবী, যুবদলের সাইফুল আলম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, এস এম জাহাঙ্গীর, স্বেচ্ছাসেবক দলের মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, মহিলা দলের সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরিন খান, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, শহিদুল ইসলাম বাবুল, জাসাসের হেলাল খান, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন, তাঁতী দলের মজিবুর রহমান, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ছাত্রদলের ফজলুল রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল, আমিনুর রহমান আমিন, সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ। গণঅনশনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান, এনডিপির আবু তাহের, ডিএলের সাইফুদ্দিন মনি, পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি, অধ্যাপক আবদুস সালাম, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, এম আবদুল্লাহ, কাদের গনি চৌধুরী প্রমুখ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর