বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

আগুনের উৎসের খোঁজে গোয়েন্দারা

সিসিটিভি ফুটেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, প্রকৃত তথ্য সরবরাহ না করাকে নেওয়া হচ্ছে গুরুতর অপরাধ হিসেবে

সাখাওয়াত কাওসার ও মুহাম্মদ সেলিম, সীতাকুণ্ড থেকে ফিরে

আগুনের উৎসের খোঁজে গোয়েন্দারা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনের উৎসের সন্ধানে নেমেছেন গোয়েন্দারা। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে, কী কারণেই বা দাহ্য না হওয়ার পরও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ঘটনার তদন্তে গঠিত পাঁচটি কমিটির সদস্যরা। তবে এরই মধ্যে জানা গেছে, ডিপোর অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা থাকার পরও কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো পুড়ে গেলেও ডিপোর অফিস কক্ষে (নিরাপদ দূরত্বে) রাখা ফুটেজ সংরক্ষণ যন্ত্র (ডিভিআর) কেন পুড়বে? আগুন ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই তা কেন নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলা হলো না তা নিয়ে নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে।

অনুসন্ধান বলছে, শনিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস সীতাকুণ্ড স্টেশন শীতলপুরে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার প্রথম খবর পায়। সর্বপ্রথম কুমিরা স্টেশনের ফায়ার দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায় রাত ১০টা ২৫ মিনিটে। এরপর কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সীতাকুণ্ড স্টেশনও যোগ দেয় অগ্নি নির্বাপণে। তবে বিএম কনটেইনার ডিপোতে দায়িত্বরত কেউই বিভিন্ন শেডে থাকা কনটেইনারের সামগ্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি ফায়ার ফাইটারদের। শুধু পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন ফায়ার ফাইটাররা। নেভার বদলে ক্রমেই ভয়ংকর হতে থাকে আগুন। সঙ্গে হতে থাকে থেমে থেমে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। বাড়তেই থাকে আগুনের মাত্রা। সেই অগ্নিকাণ্ডে কুমিরা স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মিঠু দেওয়ান ও এমরান হোসেন মজুমদার নামের দুজন মারা যান। একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যসহ মোট ৪৪ জনের নির্মম মৃত্যু হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। আগুন নেভাতে গিয়ে খোদ কুমিরা স্টেশনের  সিনিয়র স্টেশন মাস্টার সুলতান মাহমুদ গুরুতর অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। বিস্ফোরণের সময় ডিপোতে দায়িত্বরত ছিলেন ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাস। অন্যদের সঙ্গে ওই দিন তিনিও আহত হন। বর্তমানে তিনি সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখতে পাই কনটেইনারে আগুন জ¦লছে। তখন আগুনের উৎসের বিষয়ে ডিপোর কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করা হলেও কোনো উত্তর দিতে পারেননি। বিস্ফোরণে অন্যদের সঙ্গে আমিও আক্রান্ত হই।’

সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল আলম দুলাল ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘রাত ৯টা ৫০ মিনিটে আমাদের কাছে ডিপোতে আগুন লাগার খবর আসে। ফোন পেয়ে আগুনের উৎসের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কর্তৃপক্ষ কোনো উত্তর দেয়নি। আমরা এখনো জানতে পারিনি ওই দিনের আগুনের উৎস কী ছিল। বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের শুরু থেকে ঘটনাটি নিয়ে কাজ করেছেন এমন একাধিক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলছিলেন, ক্যামেরা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কোনো সমস্যা নয়। অকেজো হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্যামেরা ফুটেজগুলো সরবরাহ করতে থাকে কন্ট্রোল প্যানেলে কিংবা ডিভিআরে। সেখানেই ফুটেজ সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্যানেলে কোনো সমস্যা হলে কিংবা পুড়ে গেলেও তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রকৃত তথ্য না দেওয়ার বিষয়টিও বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, ‘কীভাবে আগুনের সুত্রপাত তা এখনো জানতে পারিনি। তবে আগুনের উৎস সন্ধানে ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। আশা করছি আলামতগুলো বিশ্লেষণ করে আগুনের উৎসের সন্ধান পাব।’

জানা গেছে, বিএম কনটেইনার ডিপোর চারপাশে এবং বিভিন্ন শেডে শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। এগুলোর কন্ট্রোল প্যানেল কিংবা ডিভিআর ছিল প্রতিষ্ঠানের মূল অফিস ভবনে। তবে অন্য কোথাও এর ব্যাকআপ আছে কি না সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানের কেউ। সব শেষ এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদের কাছে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিষয়গুলো ভালো জানেন এমন কাউকেই তো আমরা পাচ্ছি না। তবে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় অবহেলার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় ডিপোর আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী। এখন আগুন নিভেছে। এসব বিষয়ে তথ্য নেওয়া হবে। তবে যতদূর জানতে পেরেছি ডিপোর মাঝখানের একটি শেডের পাশের দ্বিতল ভবনে কন্ট্রোল প্যানেল ছিল। সেগুলো নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।’

অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে অন্যান্য সংস্থার মতো ব্যস্ত সময় পার করছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) সদস্যরা। এটিইউয়ের পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের সিবিআরএন (কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল ও নিউক্লিয়ার ইনসিডেন্ট) বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতেই আমাদের মূল ফোকাস। এই টিমের সদস্যরা দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর মতো ভবাবহ অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণগুলো খুঁজতে আমাদের টিম সেখানে কাজ করছে। আমাদের উদ্দেশ্য, লিগ্যাল এসপেক্টে এটি কতটুকু ঠিক ছিল সেটি বের করা।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিএম কনটেইনার ডিপোর অন্যতম প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের জিএম ও মুখপাত্র শামসুল হায়দার সিদ্দিকীর কাছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আগুনের উৎসের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কারণ ডিপোতে যে সিসিটিভি ফুটেজের কন্ট্রোল প্যানেল ছিল তাও পুড়ে গেছে। কনটেননার থেকে আগুনের সূত্রপাত প্রত্যক্ষ করেছে এমন কাউকেও আমরা খুঁজে পাইনি। তবে আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে আগুনের সূত্রপাত চিহ্নিত করার।’

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (সদ্য অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) এস এম রশিদুল হক বলেন, ‘আগুনের উৎস সন্ধান এবং অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে তদন্ত দল। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলা যাবে না।’

সর্বশেষ খবর