বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশেষ কলাম

বাংলাদেশ-ভারত সাম্প্রদায়িকতার বিপদ রুখতে পারে যেভাবে

আসাদুজ্জামান খান

বাংলাদেশ-ভারত সাম্প্রদায়িকতার বিপদ রুখতে পারে যেভাবে

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ ছিল এক নবীন রাষ্ট্র। কিন্তু দেখতে দেখতে তারও বয়স ৫০ পেরিয়ে গেল। একসময় দেশে-বিদেশে অনেকে ভেবেছে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না; টিকবে না এ দেশ। কিন্তু পাঁচ দশক পরের অভিজ্ঞতা বিস্ময়কর। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে টিকে আছে এবং অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে। বাংলাদেশের এ ঐতিহাসিক উদ্যাপনেও  বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকা। নয়াদিল্লির সে সময়কার সহায়তা, সহানুভূতি ও মদদ বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করে। তবে এও সত্য, ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের এখনকার অনুভূতি মিশ্র। এর কারণ ভারতের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক। বাংলাদেশের এ প্রত্যাশা ইতিবাচক। কারণ বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবেই জানে প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। এ এক স্থায়ী বাস্তবতা। সুতরাং ভারতকে বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ এগোতে চেয়েছে সব সময় এবং আগামীতেও সে বাস্তবতা বদলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রত্যাশাগুলোও ভারতীয়রা সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনায় রাখবে বলেই এখানকার ১৭ কোটি মানুষ আশা করছে বরাবর। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্পর্শকাতর বিষয় খুব বেশি নয়। তবে তার মধ্যে অবশ্যই একটা হলো ধর্ম। উভয় দেশে রয়েছে বিশ্বের প্রধান দুটি ধর্মের বিপুল অবস্থিতি। আবার ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ হলেও বিশ্বের বড় এক মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে সেখানে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান হলেও প্রায় ১০ ভাগ হিন্দুও আছে এখানে। জনসংখ্যা ও ধর্মের এ রকম বহুত্ববাদী বিন্যাস এ অঞ্চলের সম্পদ এবং সমস্যা দুটোই। ধর্মীয় বহুত্ব দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য দিয়েছে। একই সঙ্গে দিয়েছে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকার জরুরি প্রয়োজনীয়তা। এ বাস্তবতা স্বীকার করেই আমাদের এগোতে হবে যে ভারতে মুসলমানদের যে-কোনো কষ্ট ও অপমান বাংলাদেশে আবেগ তৈরি করবে। আবার একই সঙ্গে বাংলাদেশের হিন্দুদের যে-কোনো অসন্তোষ ভারতে প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। ইন্টারনেটের যুগে এ রকম পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার রয়েছে ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিবিধ বন্ধন। কখনো কখনো ধর্মীয় বিবেচনা যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক এসব বন্ধন অতিক্রম করে যেতে চায় তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, সমসাময়িক জটিল সময় ও বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশ নিজ নিজ পরিমন্ডলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কীভাবে রক্ষা করতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি কারণ এর বিশ্বাসযোগ্য ফয়সালা ছাড়া উভয় দেশে সামাজিক অস্থিরতা স্থায়ীভাবে রোখা যাবে না। একই সঙ্গে উভয় দেশের সম্পর্কেও তা কালো ছায়া বিস্তার করে রাখবে। সুতরাং উভয় দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য অন্যতম কর্তব্য হলো অর্থনীতিসহ সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে করণীয় নিয়ে ভাবা। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হবে? কীভাবে তা অর্জিত হতে পারে? এটা অর্জনের একক রাস্তা হলো উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের জায়গাগুলো ক্রমাগত কমিয়ে আনা। তাতে জনগণের মধ্যে এ রকম এক বোধ তৈরি হবে যে, আমরা উভয় দেশের মানুষ একই মিলিত স্বার্থের অংশীদার। আমরা একই সঙ্গে এগোচ্ছি। সংঘাত নয়, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও যৌথতাতেই রয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎ। ভারত বিশাল রাষ্ট্র। তার অনেক প্রতিবেশী। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সমীকরণের কারণেই বাংলাদেশ ভারতের বিদেশনীতিতে অগ্রাধিকারমূলক বিষয় হওয়া দরকার। বাংলাদেশের দিক থেকে এটা মোটেই সুখকর অভিজ্ঞতা নয় যে, তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় দশকের পর দশক অমীমাংসিত হয়ে পড়ে আছে কূটনীতিকদের ফাইলে। এগুলো বাংলাদেশের মানুষকে অসুখী করে। এ অসুখী মনস্তত্ত্বে যদি রাজনীতিবিদরা জল দেন তাহলে সেটা অরাজনৈতিক বিরোধের আদল নেয়। এটাই আবার অতি ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার পালে বাতাস জোগায়। আবার ঠিক উল্টো দিকে, বাংলাদেশের উত্থাপিত বিষয়গুলো যদি ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা সব সময় দ্রুত বিবেচনায় নেন এবং তার মর্যাদাপূর্ণ সমাধান হাজির করেন তাহলে সেটা কেবল এখানকার রাজনীতিতে নয়, প্রান্তিক স্থানীয় সমাজেও এমন এক ইতিবাচক আবেগ তৈরি করে যা পরোক্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করে। মনে রাখতে হবে, এ উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে ভারত রয়েছে চালকের আসনে। আন্তনদীর পানি, সীমান্তে বেসামরিক মানুষের রক্তপাত, বাণিজ্যে ভারসাম্য ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ভারত ন্যায়ত আরও অনেক কিছু করতে পারে এবং তা করা হলে তার তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখব আমরা এখানকার সমাজের চৌহদ্দিতে ও আন্তধর্মীয় সম্পর্কে। একইভাবে উভয় দেশের তৃণমূলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নয়নে বাংলাদেশেরও করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং নিয়োগে যে সাম্প্রদায়িক বিবেচনার ঠাঁই নেই বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে এখানকার প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বিপুলভাবে উপস্থিত রয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্য প্রচারের ঘাটতি রয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ প্রকৃতই ভারতে নিজেকে ব্র্যান্ডিং করতে পারেনি আজও। বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের সঠিক ধারণা তুলে ধরতে ভারতীয় নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিদের এখানে সফরে আহ্বান জানাতে পারে। এটা এ কারণে জরুরি যে, তৃতীয় কোনো পক্ষ যেন ভারতবাসীকে বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা দিতে না পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে এতদঞ্চলে ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বুঝতে হবে এবং প্রতিনিয়ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সেসব বিষয়ে সংলাপ চালানোর মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া এখানে অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবেই দেখতে হবে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সেটা করছেও। স্বাধীন দেশ হিসেবে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের একটা প্রধান উপলব্ধি হলো, এখানকার সমাজে শান্তিপূর্ণ আন্তধর্মীয় পরিবেশের প্রধান এক শর্ত হলো ভারতে আন্তধর্মীয় শান্তি এবং সে দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক। এ অভিজ্ঞতা আরও এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু এখানে আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জও বিপুল। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে উগ্র ডানপন্থার উত্থান দেখছি আমরা। এর অনিবার্য ছাপ পড়ছে এবং পড়বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি তার দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য আড়াল করতে চাইতে পারে ধর্মীয় বিভেদ উসকে দিয়ে। এ রকম হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই। অথচ এ অঞ্চলের দেশগুলোর পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের সার্ক কাঠামোও এ মুহূর্তে অনুপস্থিত। দক্ষিণপন্থার বিপদ যেমন এক দেশের আন্তধর্মীয় ঘৃণা অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারে, তেমনি দেশগুলোর নেই উত্তেজনা হ্রাসের কোনো সম্মিলিত কাঠামো। বলা বাহুল্য, এ দুই বিপদ চটজলদি সমাধা করা যাবে না। কারণ ডানপন্থা ও লোকরঞ্জনবাদ বর্তমানে ভোটের রাজনীতিতে এক সফল মডেল হিসেবে প্রলুব্ধ করছে রাজনীতিবিদদের। আসন্ন নেতিবাচক এ চ্যালেঞ্জ দমিয়ে রাখতে হলে এবং শুকিয়ে মারতে হলে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারকদের এখনই জরুরি ভিত্তিতে তিস্তার পানি বণ্টনসহ দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোয় সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফয়সালায় আসতে হবে। মানুষ যখন দেখবে উভয় দেশের মধ্যে বিবাদিত বিষয়গুলো অবহেলিত নয়, তখনই কেবল উভয় দেশ বহুত্ববাদ ও বহুজনবাদের উর্বর জমিন হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের স্মৃতি ইতিহাসের পাতায় ব্যতিক্রমী অধ্যায় হিসেবে রেখে দিতে চায় না। চাইছে, সেদিনের পারস্পরিক আবেগকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের স্থায়ী এক পাটাতন হিসেবে গড়ে তুলতে। এটাই সীমান্তের দুই দিকে সম্প্রীতি গড়ার ব্যবহারিক পথ।

                লেখক : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর