বাশার বারহৌমের বয়স ৬৩। লেখক। মাস সাতেক আগে তাকে আটক করে আসাদ বাহিনী। ঠাঁই হয় দেশটির কুখ্যাত ‘কসাইখানা’ খ্যাত কারাগারে। সেখানে ঢোকার পরই তার মনে হয়ে ছিল তিনি মৃত্যুপুরীতে চলে এসেছেন। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। তবে বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কতটা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতে পারে তাকে। এ অবস্থায় গত পরশু সেই কারা সেলে মানুষ ঢুকেছে। সে আদতে কে? প্রথম কয়েক সেকেন্ড তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যিনি ঢুকেছেন, তিনি ‘স্বৈরাচারী’ শাসক আসাদেরই লোক। মুহূর্ত পরই বুঝলেন, প্রবেশকারী তারই মুক্তিদাতা, বিদ্রোহী গোষ্ঠীরই একজন, যারা সদ্য সিরিয়ায় ক্ষমতার দখল নিয়েছে, সে এসেছে তাকে মারতে নয়, বরং আরও একবার বাঁচার সুযোগ করে দিতে! বিস্ময়ে, আনন্দে চোখের জল বাধ মানছিল না এই প্রবীণ লেখকের। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিজয়ের পর বাশার আল আসাদের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তার মতো লাখো বন্দি।
বাশারের শাসনামলে কারাগারগুলো ছিল নির্মম নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক। এই কারাগারগুলো থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন হালা, যিনি ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কারাগারে তিনি নামের বদলে পরিচিত ছিলেন ‘১১০০’ হিসেবে। কারাগারের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে হালা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটি সত্যি যে আমরা মুক্ত। এটি যেন আমার নতুন জন্ম।’ দামেস্কের পথে তখন যেন স্বাধীনতার উল্লাস। বিহ্বল লেখক বাশার বারহৌমের, যিনি সাত মাস আকাশের রঙ ভুলে গিয়েছেন, খুঁজছেন তার ব্যক্তিগত জিনিপত্র, নিদেন মোবাইল ফোনটি, যাতে স্ত্রী ও কন্যাকে জানাতে পারেন, হ্যাঁ, তিনি বেঁচে আছেন। বেঁচে গেলেন এ যাত্রা।
রবিবার ক্ষমতা দখলের পরই বিদ্রোহীরা এইচটিএস এই কসাইখানা থেকে শতাধিক রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। ২০১১ থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার চেয়ে যারাই প্রতিবাদ করেছেন, তাদের জেলবন্দি করেছিলেন আসাদ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, শুধু ২০১১ থেকে ২০১৬ এর মধ্যেই অন্তত ১৩ হাজার সিরীয়কে হত্যা করা হয়েছে এই কারাগারে। প্রতি সপ্তাহে মারা পড়েছেন ডজন ডজন মানুষ। যাঁরা বেঁচে থাকতেন, তাঁদের ওপরও চলত অকথ্য অত্যাচার। সেই সঙ্গে অনাহারে রাখা হতো বন্দিদের। ২০১৩ সালে সিরীয় মিলিটারি থেকে ‘সিজার’ নামে এক দলত্যাগকারী জেল-অন্দরের প্রায় ৫৩ হাজার ছবি তুলে পাচার করেন। যা সিরিয়ার এই কুখ্যাত জেলখানার অমানবিক চিত্র তুলে ধরে বিশ্বের কাছে। কী পরিমাণ অত্যাচার আর হিংসার শিকার হতে হয়েছে বন্দিদের, এই ছবিগুলিই তার অকাট্য দলিল। সোমবার কারাগারের দরজা খুলতেই বৃদ্ধ-শিশু-মহিলা-সহ শয়ে শয়ে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েন। ছোট্ট একটা সেল। সেখানে ঠাসাঠাসি করে থাকা মহিলারা প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। তখনই প্রায় দৈববাণীর মতো তাদের কানে আসে একটাই বাক্য: ‘ভয় পেয়ো না, বাশার আসাদের পতন হয়েছে। এখন আর কীসের ভয়?’ তাদের আশ্বস্ত করে এমন কথাই বলেছিলেন এক এইচটিএস যোদ্ধা। -আল জাজিরা