সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

দেশভাগের দায়দায়িত্ব

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দেশভাগের দায়দায়িত্ব

ভারতবর্ষকে যে হিন্দুস্থান-পাকিস্তানে ভাগ করে সব মানুষের স্থায়ী ক্ষতি এবং বহু মানুষের সমূহ সর্বনাশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার দায়ভাগ কাজটা যারা করেছেন তাদের তুলনায় ভুক্তভোগীদেরই বহু শতগুণ বেশি পরিমাণে বহন করতে হয়েছে। কর্তাব্যক্তিরা দায়ভাগ তেমন বহন করেননি, ভান করেছেন দায়িত্ব পালনের, কোনো কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতে হয়নি, তবে ইতিহাস যে তাদের ক্ষমা করবে না এটা স্থির নিশ্চিত। এই কর্তাব্যক্তিরা কারা? তারা তিন দলে বিভক্ত কিন্তু তিন দল আবার একদলও বটে। তিনটি স্বতন্ত্র দলকে আমরা অবশ্যই চিনি। একদিকে কংগ্রেস, অপরদিকে মুসলিম লীগ, পেছনে হাস্যরত অন্তর্যামীর মতো শাসক ব্রিটিশ। কংগ্রেস প্রথমে বলেছে ভারতবর্ষীয়রা এক জাতি, কাজেই ভারতবর্ষকে অখণ্ড রাখতে হবে, ভাগ করা চলবে না; পরে অবশ্য তারা হিন্দুস্থান-পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিকরণ মেনে নিয়েছে, কেবল যে মেনে নিয়েছে তা নয়, কংগ্রেসের ভেতরকার দক্ষিণপন্থি অংশ, যাদের ছদ্মবেশী হিন্দুমহাসভাপন্থি বলাটা অন্যায্য নয়, তারা অস্থির হয়ে পড়েছিল নিজেদের ভাগটা বুঝে নেওয়ার জন্য।

অপরদিকে মুসলিম লীগ প্রথমে নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থার দাবি দিয়ে শুরু করেছে কিন্তু ১৯৪০ এর পর থেকে স্বতন্ত্র বাসভূমির চাহিদার কথাটাকে ক্রমান্বয়ে তীব্র করে তুলেছে এবং শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্থান-পাকিস্তান ভাগাভাগি চেয়েছে। অবশ্য এটা তাদের দূরবর্তী কল্পনার মধ্যেই ছিল না যে, পাকিস্তান কায়েম করতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবের অর্ধেকটা হিন্দুস্থানের হাতে তুলে দিতে হবে।

দেশভাগের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে হিন্দুমহাসভা ছিল মুসলিম লীগের চেয়েও অধিক স্থিরনিশ্চিত। তাদের নেতা বীর সাভারকার জিন্নাহর আগেই দ্বিজাতিতত্ত্বের তপ্ত মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। তার মতে ভারত হচ্ছে হিন্দুর দেশ, মুসলমানরা এখানে বসবাস করে বলেই যে পূর্ণ নাগরিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য হয়ে গেছে তা নয়। সাভারকারের বিশিষ্ট সহযোগী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন, ছোটলাটের ভোজসভায় তিনি ধুতি পরে উপস্থিত হতে পছন্দ করতেন কিন্তু তিনি আবার নিজেকে হিন্দু হিসেবেও জানতেন, যে জন্য তিনি দেশ ভাগ হবে কি হবে না নিয়ে সংশয় দেখা দিলে প্রবল কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভারতবর্ষ অখণ্ড থাকলেও বাংলাকে অবশ্যই দুই টুকরা করতে হবে, কেননা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আধিপত্য মানবে না। দুই টুকরা হলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে সে নিয়ে অবশ্য তার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, যেমন জিন্নাহর দুশ্চিন্তা ছিল না হিন্দুস্থানে রয়ে যাওয়া পাকিস্তানিদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) সম্ভাব্য দুর্দশা বিষয়ে। দেশভাগের জন্য মুসলিম লীগকেই অধিক পরিমাণে দায়ী করার রেওয়াজ রয়েছে কিন্তু কংগ্রেসের দায়িত্বটা মোটেই কম ছিল না। আর পেছনে ছিল ব্রিটিশ শাসকরা। আসল কলকাঠি তারাই নাড়ছিল।

পরাধীন ভারতবর্ষে জনগণের মুক্তির পথে বড় অন্তরায় ছিল তিনটি- শ্রেণী, জাতি ও পরাধীনতা। পরাধীনতাটা ছিল সর্বাগ্রগণ্য ও সর্বজনীন, শ্রেণী ও জাতি নির্বিশেষে সবার জন্যই পরাধীনতা ছিল সত্য। সাধারণ মানুষ আটকা পড়েছিল শ্রেণীর প্রাথমিক বন্ধনে কিন্তু তারা আবার জাতিগতভাবেও পীড়িত ছিল, বিজাতীয় ব্রিটিশ তাদের শোষণ ও শাসন করছিল। ওই শাসকদের বিতাড়িত করতে না পারলে অন্য দুই সমস্যার অর্থাৎ জাতিগত ও শ্রেণীগত নিপীড়নের সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল না। প্রধান দ্বন্দ্বটা তাই ছিল সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই। ব্রিটিশ শাসকরা শ্রেণী অভ্যুত্থানকে ভয় পেত। ১৮৫৭-এর জনঅভ্যুত্থান তাদের এটা শিখিয়েছিল যে, ওই অভ্যুত্থানে সেদিনকার মধ্যবিত্ত যোগ দেয়নি বলেই অভ্যুত্থানটি সামাজিক বিপ্লবের আকার ধারণ করেনি। মধ্যবিত্ত অবশ্য তখন সবে গড়ে উঠেছে; তবে শিক্ষা, পেশা ও ব্যবসার মধ্যদিয়ে তারা যে আরও বিকশিত হবে সেটা তো নিশ্চিত ছিল এবং শাসকরা তাদের নিজেদের কাজকর্মের সুবিধার জন্য এই বিকাশকে উৎসাহিতও করছিল।

লর্ড কার্জন তো স্পষ্ট করেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বাঙালিরা নিজেদের একটি জাতি বলে ভাবে এবং এই সেই দিনের সুখ স্বপ্ন দেখে যেদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে একজন বাঙালিবাবু কলকাতার লাটভবনে স্থাপিত হবে। বলা বাহুল্য, এই স্বপ্ন ভেঙে দেওয়াটাই ছিল কার্জনদের প্রধান উদ্দেশ্য, যার জন্য ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে, এতে করে বাঙালি 'জাতি' ভেঙ্গে দুই টুকরা হবে এবং জাতীয়তাবাদের জায়গায় সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেবে। বাঙালিরা (অর্থাৎ বাঙালি মধ্যবিত্তরা) নিজেদের জাতি বলে ভাবছিল; এরপরে পাঞ্জাবি, মারাঠি, পাঠানরাও ওই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করবে এমন আশঙ্কাও ছিল। ফলে ইংরেজের পক্ষে শান্তিতে থাকাটা কঠিন হবে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর নির্ভর না করে ওই শ্রেণীকে সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রের সাহায্যে দু'ভাগ করাটাই ছিল নতুন সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাংলায় গোলযোগ দেখা দিল। আন্দোলন হলো। তাই ভাগাভাগিটা ওই রকম ভাবে অর্থাৎ কেবল ভৌগোলিক ও স্থানীয় না-করে 'মতাদর্শিক' এবং সর্বভারতীয় রূপ দান করাকেই অধিকতর উপযোগী বিবেচনা করা হয়েছিল।

ভোটাধিকার তখন অত্যন্ত সীমিত ছিল; বাড়তে বাড়তে সেটা দেশভাগের সময় মাত্র শতকরা ১৩ জন পর্যন্ত পেঁৗছয়; এরই মধ্যে মুসলমানদের পক্ষ থেকে দাবি করা হলো পৃথক নির্বাচনের। শুরুতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, পৃথক নির্বাচন জাতিকে বিভক্ত করে ফেলবে। মোটেই ভুল বলেননি। এবং বিভক্ত করাটাই ছিল শাসকদের অভিপ্রায়। পৃথক নির্বাচন কেবল যে আইনসভাগুলোর নির্বাচনের ক্ষেত্রের বিভক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল তা নয়, এটা অন্যান্য এলাকায়ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করল।

বস্তুত সাম্প্রদায়িকতার বিকাশের ব্যাপারে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা যতটা নয় তারচেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ছিল ওই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনই সাম্প্রদায়িকতাকে নতুনতর মাত্রায় উন্নীত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর রকমের দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়ে দেশবিভাগকে অনিবার্য করে তুলেছে। সামনে ছিল কংগ্রেস ও লীগ, পেছনে ইংরেজ। দাঙ্গাহাঙ্গামার সময় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বিপদে পড়েছে, নিরাপদে থেকেছে ব্রিটিশ শাসকরা। জনগণের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক বিপ্লবের তার সম্ভাবনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

বিদেশি শাসকরা কখনো কংগ্রেসের কখনো লীগের দিকে ঝোঁকার ভান করেছে এবং দুইয়ের মধ্যকার বিরোধটার যাতে কিছুতেই মীমাংসা না হয় বরঞ্চ সেটি তীব্রতর হতে থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। সিপাহী অভ্যুত্থানের পর তারা মুসলমানদের অপছন্দ করছে বলে মনে হতো। পরে কংগ্রেস প্রবল হলে কংগ্রেসের ওপর তারা বিরক্ত হলো এবং ভান করল যে তারা মুসলিম লীগকেই পছন্দ করে। এদিকে জিন্নাহ কেবল যে মুসলমানদের লীগের পতাকাতলে নিয়ে এলেন তা নয়, লীগের তিনি একমাত্র মুখপাত্রেও পরিণত হলেন। অবশ্য জিন্নাহ তার অনুসারীদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলেন বলে ওয়াভেলের মনে হয়েছে। জিন্নাহর জন্য খুব বড় একটা অসুবিধা অবশ্যই ছিল। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন, ভারতের যে মুসলমানরা এতকাল একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল তাকে তিনি একটি 'জাতি'তে পরিণত করেছেন, এখন যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হয় তাহলে তিনি তার ধাবমান অশ্ব থেকে কোনো নিরাপদ ভূমিতে অবতরণ করবেন? অথচ পাকিস্তান যে কোন ধরনের রাষ্ট্র হবে, তার সীমানাই বা কি হবে সেটা অন্যদের তো জানার কথাই নয়, তিনি নিজেই জানতেন না। বিশেষ করে সমস্যা ছিল ওই সীমানা তথা ভৌগোলিক এলাকাটা নিয়ে। পাকিস্তান যদি কেবল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত হয়, তবে ভারতের সর্বত্র যে মুসলমানরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের দশাটা কি হবে, তারা কোথায় যাবেন, কোন রাষ্ট্রের নাগরিক হবেন- এসব অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর তার কাছে ছিল না।

ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তি অর্জনের জন্য দরকার ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ, অব্যাহত ও ধারাবাহিক আন্দোলনের এবং দেশটি যে এক বা দুই জাতির দেশ নয়, দেশ বহুজাতির বটে সেই সত্যের কার্যকর স্বীকৃতিদানের। আন্দোলন অবশ্যই হয়েছে। কেবল আন্দোলনের কারণেই না-হলেও আন্দোলনের পরিণতিতেই ব্রিটিশ ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সে আন্দোলন সংগ্রামের ঐক্যকে ধরে রাখতে পারেনি; বরঞ্চ সাম্প্রদায়িক বিভেদকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তার বৃদ্ধিও ঘটিয়েছে।

প্রথম বড় আন্দোলন হয় ১৯২০ সালে, যখন অসহযোগ ও খিলাফত এই দুই ধারা একত্র হয়ে আন্দোলনকারী হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি করেছিল। কিন্তু সেটা টেকেনি। ১৯৪৬ সালে লিখিত কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট সদস্য হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় 'হিন্দু ও মুসলিম' নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, 'সাম্প্রদায়িক মৈত্রী যখন প্রায় অটুট বলে মনে হচ্ছিল তখনই মাঝে মাঝে দু'য়েকটা খারাপ সংকেত দেখা দিত।

৮ সেপ্টেম্বর ১৯২০ তারিখের ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় গান্ধীজী লেখেন যে সভা-সমিতিতে হিন্দু আর মুসলমান যেন রেষারেষি করে 'বন্দে মাতরম' কিংবা 'আল্লা-হো-আকবর' রব তোলে, অথচ রব তুলতে হলে সকলেরই সমান অনুরাগ ও আবেগ নিয়ে তা করা উচিত।

কংগ্রেসের আন্দোলনের একটি বড় দুর্বলতা ছিল এই যে, জনগণকে সে সঙ্গে নিতে পারেনি। এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে অসহযোগ-খিলাফতের আকস্মিক প্রত্যাহারের পর বিক্ষুব্ধ মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশ বিকল্প পথ ধরতে চাইলেন বটে, কিন্তু জনগণের কাছে যে যাবেন তা করলেন না, ওই কংগ্রেসের ভেতরেই রয়ে গেলেন, ভেতরে থেকেই স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলেন, এবং সেই পার্টির গন্তব্য স্থির হলো আন্দোলন নয়, আইন সভাতে যাওয়া। হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূলটি যে নিহিত আছে অর্থনীতিতে চিত্তরঞ্জন তা পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন। আন্দোলনের নেতারা ব্রিটিশকে যত ভয় করত তার চেয়ে বেশি ভয় করত জনগণের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকে। এইখানে ওই তিন শক্তি-ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও লীগ-পরস্পর থেকে দূরে ছিল না, ছিল নিকটবর্তী। লক্ষণীয় যে এরা সবাই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষে ছিল; প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন না চাইত কংগ্রেস, না চাইত লীগ; আর ব্রিটিশের পক্ষে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার একটা ভান করা হতো, কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনকে অক্ষত রাখার স্বার্থেই।

ব্রিটিশ সরকারের নীতি আগাগোড়াই ছিল ভাগ কর এবং শাসন করো। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট যখন কলকাতায় সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হয় তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল, সামরিক বাহিনী রাস্তায় নেমেছে ২৪ ঘণ্টা পার করে দিয়ে, এবং বড়লাট কলকাতায় কী ঘটেছে দেখতে এসেছেন এমনকি এক সপ্তাহও নয়, পুরো নয় দিন পরে। কলকাতার দাঙ্গা নোয়াখালী, বিহার, দিলি্ল এবং পরে পাঞ্জাবে ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাবের দাঙ্গা যে অতিশয় ভয়াবহ আকার ধারণ করবে গোয়েন্দা সূত্রে মুসলমান, শিখ ও হিন্দু তিন পক্ষের প্রস্তুতির খবর থেকে তার পূর্বাভাস সরকার ঠিকই পাচ্ছিল, কিন্তু মোকাবিলার জন্য তেমন কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, নিজের দেশে সংকট এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষের অতিউত্তপ্ত অবস্থার দরুন ভারতবর্ষকে যখন কিছুতেই আর অধীনে রাখা যাচ্ছিল না তখন শুরু হয় দেশভাগের কাজ। ব্রিটিশ মহলে ইতোমধ্যেই হিন্দুস্থান পাকিস্তান নামাবলী চলে এসেছে।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হককে প্রয়োজনের সময় 'শেরে বাংলা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল, তাকে দিয়ে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারপর থেকেই মুসলিম লীগ হাই কমান্ড তাকে ক্রমাগত কোণঠাসা করতে শুরু করে দিয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন হয়েছে যে তখনকার বাংলার রাজনীতিতে যার পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবার কথা, দেশভাগের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তার কোনো ভূমিকাই দেখা গেল না, বঙ্গীয় আইনসভার সদস্যরা যখন হিন্দুস্থান-পাকিস্তান নিয়ে ভোটাভুটি করে তখন ওই সভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি উপস্থিত পর্যন্ত ছিলেন না। সুভাষচন্দ্র বসু তখন দেশে ছিলেন না। শরৎচন্দ্র বসু ছিলেন, তিনি ছিলেন বঙ্গীয় আইনসভার কংগ্রেস দলের নেতা, বাংলাভাগের ব্যাপারে তার মতামতও নেওয়া হয়নি, তিনি বরং বাংলাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিলেন, যেটা ফজলুল হকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ ফজলুল হকের রাজনৈতিক অবস্থান তখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শরৎবসুকে কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য করা হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য, পরে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন এবং আরও পরে, মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বাংলা ভাগ হলো, কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, নেতারাও তাদের অসম্মতির কথাটা জানানোর সুযোগ পেলেন না।

১৯৩৭ সাল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। তখন আটটি প্রদেশে কংগ্রেসের নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়। বাংলাতেও কংগ্রেসের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারত। প্রজা পার্টির ফজলুল হক মনেপ্রাণে সেটা চেয়েছিলেন, প্রাদেশিক কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা শরৎবসুও খুবই আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারেনি কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের হাই কমান্ডের হস্তক্ষেপে। (হাই কমান্ড ব্যাপারটা তখন কংগ্রেস এবং লীগ উভয় সংগঠনেই সংগঠিত হয়ে গেছে।) চিত্তরঞ্জনের অকাল মৃত্যুতে বাংলার স্বতন্ত্র রাজনীতি একদিন বড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছিল, ১৯৩৭-এ সেটা বস্তুত শেষই হয়ে গেল। বাংলা অন্তর্গত হয়ে গেল সর্বভারতের, এবং তার নিজস্ব বক্তব্য বলে কিছু যে থাকবে সে অবকাশ আর রইল না। সেদিন প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস মিলিত হয়ে যদি একটি অসাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারত এবং এমন যদি হতো যে সুভাষ বসু সর্বভারতীয় না হয়ে বাংলার রাজনীতিতে থাকতেন, তাহলে রাজনীতির ইতিহাস কোন পথে এগুতো আমরা জানি না, কিন্তু বাংলাকে ভাগ করা অতটা সহজ হতো না, যতটা হয়েছিল, এবং বাংলা ভাগ না হলে পাঞ্জাবকেও ভাগ করা কঠিন হতো। বস্তুত যারা ভাগ করেছিলেন তারাও বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ দুই টুকরা হতে সম্মত হবেন বলে আস্থা রাখতে অসুবিধাবোধ করছিলেন। পাঞ্জাবের জন্য এ ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে যে, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান ভাগাভাগির সময়ে তিনি জীবিত ছিলেন না। ১৯৪২ এর ডিসেম্বরে তার জীবনাবসান ঘটে, এবং তারপরে পাঞ্জাবে যারা রাজনীতি করছিলেন তাদের কারোই ব্যক্তিত্ব তার মাপের ছিল না। বলা বাহুল্য, এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছিল জিন্নাহর।

মুসলিম লীগ হাই কমান্ডও যে বাঙালিবিদ্বেষী ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই কমান্ড ফজলুল হককে তো অপ্রাসঙ্গিক করেছেই, জিন্নাহ-অনুগত সোহরাওয়ার্দীকেও ওয়ার্কিং কমিটিতে নেয়নি; এবং ১৯৪৬ এর নির্বাচনে যদিও সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনিই অবিভক্ত বঙ্গের শেষ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তবু দেশভাগের পরে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়নি, করা হয়েছে খাজা নাজিমুদ্দিনকে, যিনি নির্বাচনে কোনো ভূমিকা তো রাখেনইনি, এমনকি নির্বাচনে প্রার্থীও ছিলেন না। ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে এই অতি বিশ্বস্ত নাজিমুদ্দিনকেও জিন্নাহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেননি। জিন্নাহ যে পাকিস্তানের কথা ভাবতেন সেই পাকিস্তান সম্পর্কে এটা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, সেটা মোটেও পুঁজিবাদী ভিন্ন অন্যকিছু ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীও কাজ করেছেন; আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তিনি ছিলেন সভাপতি।

১৯৪৭ সালে দেশীয় পুঁজিবাদীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে, কিন্তু তাতে না এসেছে দেশের স্বাধীনতা, না এসেছে জনগণের মুক্তি। জনগণের পক্ষের প্রকৃত মিত্র ও শক্তি হওয়ার কথা ছিল কমিউনিস্টদের। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিষ্পেষণের সত্যটা তাদেরই সবচেয়ে ভালো করে জানার কথা। তারা তা জানতেনও। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপোসের যে কোনো অবকাশ নেই সেটা তারা যেমন তাত্তি্বক তেমনি বাস্তবিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। জনগণের মুক্তি তাদের আন্দোলনের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করছিল। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। যে জন্য আড়াআড়ি শ্রেণী বিভাজনের জায়গায় খাড়াখাড়ি ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভাজন বড় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িকতা দমিত হতে পারত জাতিগত সমস্যার মীমাংসা হলেও। ভারত যে বহুজাতিক দেশ এ কথাটা কমিউনিস্টরা শুরু থেকেই যে জোর দিয়ে বলেছেন তা নয়, পরে যখন বলতে শুরু করেছে তখনো ধর্ম নয় ভাষাই যে জাতি গঠনে প্রধান উপাদান তা অত্যন্ত পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেননি।

জাতিগঠনে ধর্মেরও যে একটা ভূমিকা আছে সেটা সত্য হলেও সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদের ভাষাগত ভিত্তিকে রাজনৈতিকভাবে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল তা দিতে তারা সক্ষম হননি। ফলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটাকে আপোসহীনতার স্তরে উন্নীত করে তাকে সামাজিক বিপ্লব এবং স্বাধীন জাতিগুলোর যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষ গড়ার অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আন্দোলনের নেতৃত্ব রয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসকামী পুঁজিবাদীদের হাতে, যারা ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে, গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায়নি। একদল চেয়েছে অখণ্ড হিন্দুস্থান, অন্যদলের দাবি অখণ্ড পাকিস্তান; তাদের ভয় ছিল বিত্তবানদের সঙ্গে বিত্তহীনদের শ্রেণী সংগ্রামকে, যে সংগ্রাম ঘটলে তাদের আধিপত্য ভেঙে পড়ত। ক্ষমতা রূপান্তরিত হবে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করবে এটা কংগ্রেস ও লীগ কেউই চায়নি। এই একটি ব্যাপারে তাদের ভেতরকার বন্ধুত্বটা ছিল গভীর ও অবিচ্ছেদ্য। দাবাড়ুরা তাই মিলেমিশে বেশ খাতির জমাতেই ভারতবর্ষকে কেটে দুই টুকরা করলেন, ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথে অন্তর্ভুক্ত থাকার সুযোগ হাতে পেয়ে তাকেই স্বাধীনতা বলে ঘোষণা করলেন। পরাভব ঘটল জনমুক্তির আকাঙ্ক্ষার। *

লেখক : প্রফেসর ইমিরিটাস, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

সর্বশেষ খবর