২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৯:৫৮

ফ্রিজ নিয়ে গেল খুনির কাছে

মির্জা মেহেদী তমাল

ফ্রিজ নিয়ে গেল খুনির কাছে

প্রতীকী ছবি

রাজধানী ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুল। মূল ফটক বন্ধ। ভিতরে এক যুবকের আর্তচিৎকার। বাঁচাও, কে আছো আমাকে বাঁচাও ... ওরা আমাকে মেরে ফেলল। স্কুলের ফটকের বাইরে তখন এক বৃদ্ধা চিৎকার করছেন। বলছেন, ‘গেট খোল বাবারা। আমার ছেলেকে মেরো না। ওর জীবনটা ভিক্ষা দেও।’ মিনিট বিশেক পর স্কুলের ভিতর থেকে আর আর্তচিৎকারের কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফটক ভিতর থেকে খুলে গেল।  ৮-১০ জন যুবক একে একে বেরিয়ে আসছে। তাদের শরীর, হাতে-মুখে টাটকা রক্ত লেগে আছে। সেই বৃদ্ধা মায়ের সামনে দিয়েই তারা বেরোচ্ছে। বৃদ্ধা মা তাদের প্রশ্ন করছেন, আমার ছেলে কই? ও বাবারা, আমার ছেলেরে কী করছ? কোনো জবাব কেউ দিচ্ছিল না। গেট দিয়ে সর্বশেষ বেরিয়ে এলো এক যুবক।

মাথায় চুল কম। জিন্সের প্যান্ট ও কালো রঙের টি-শার্ট পরা। এক হাতে পিস্তল আর অন্য হাতে রক্তমাখা বেয়নেট। যুবকটি স্কুল থেকে বেরিয়েই পাগলপ্রায় ওই বৃদ্ধা মাকে বললেন, ‘এত চিল্লাইতেছেন কেন। কাজের সময় এত চিল্লাইলে ভালো লাগে না। যান, আপনার পোলা ভিতরে আছে’। শেষ কথাটি শুনেই ভিতরে ছুটলেন মা। স্কুলের ভিতরে ক্লাসরুমের পাশের বারান্দায় রক্তে ভেসে যাওয়া ছেলের নিথর দেহ খুঁঁজে পেলেন তিনি।

১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা এটি। শেষ যুবকটির নাম আসলাম। যিনি সুইডেন আসলাম নামে পরিচিত। সাতসকালে ঠিক এভাবেই পৈশাচিকতার এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী খুনি আসলাম।
১৯৯৫ সালের ৪ অক্টোবর। রাত তখন আনুমানিক পৌনে ৯টা কিংবা ৯টা হবে। পুরান ঢাকার ৪ নম্বর আবদুল হাদী লেনের একটি পরিত্যক্ত  কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। মামুন এলেন সঙ্গে তার দুই সঙ্গী সন্ত্রাসী গোপাল কর ও গোপীবাগের নুরুল ইসলামকে নিয়ে। তখন মোবাইলের ব্যাপক ব্যবহার শুরু না হলেও পেজার চালু হয়েছিল। ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ও খ্যাতি ছিল। তার কোমরে পেজার। মামুন হয়তো তখনো জানত না এটাই তার শেষ রাত। আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা সুইডেন আসলাম ও তার বাহিনী মামুন, গোপাল ও নুরুল ইসলামকে কোনো সুযোগ না দিয়েই তাদের ওপর উপর্যুপরি গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। আবদুল হাদী লেনের ওই ফ্যাক্টরি থেকে গোলাগুলির শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই গোটা এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। রক্তাক্ত তিনটি লাশ পরে থাকে। পুরান ঢাকার এই নির্মম খুনের সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঢাকা শহরে। পুলিশের ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন তৎকালীন ঢাকার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিবির এসি আক্তারুজ্জামান রুনু তার টিমের চৌকস অফিসার ইন্সপেক্টর হামিদুল হক, ইন্সপেক্টর বাবুল ও এসআই আলমগীরকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখনো লাশগুলোর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল।

আসলামের স্ত্রী ইতিকে বিয়ে করায় মামুনকে তার দুই সহযোগীসহ প্রাণ দিতে হয়। সমঝোতার কথা বলে ডেকে নিয়ে এভাবেই খুন করা হয়েছিল মামুনদের।

এর পরের টার্গেট ছিল বিপুল। মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফার্মগেট আনন্দ হলের সামনে থেকে বিপুলের ঘাড়ে হাত রেখে আসলাম কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে থাকে। সঙ্গে আছে আসলামের কিলার বাহিনী। কথা বলতে বলতে আনন্দ হলের পাশের গলি তেজতুরী বাজারে নিয়ে যায় বিপুলকে। একটি মাঠে নিয়ে দিনদুপুরে বিপুলকে হত্যা করে আসলাম। এরপর কলাবাগানে কিসলুকে গুলি করে হত্যা করে শত শত মানুষের সামনে।

১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ তেজকুনিপাড়ায় খুন হন যুবলীগ নেতা মাহমুুদুল হক খান গালিব। সুইডেন আসলাম তার কিলার বাহিনী পাঠিয়ে তেজকুনিপাড়ায় বাসার সামনেই গালিবকে গুলি করে হত্যা করায়। এমন খুনের অজস্র উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন সুইডেন আসলাম।

১৯৮৫ সালে নাটকীয় উত্থান ঘটে এই সুইডেন আসলামের। কোমল পানীয় ফান্টার বোতল ভেঙে রংবাজি শুরু করা আসলামের হাতে একসময় উঠে আসে একে-৪৭ মতো মারণাস্ত্র। ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে আসলাম। তার সিরিজ খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। পুলিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তোলে। তাকে গ্রেফতারের সব অভিযানই একে একে ব্যর্থ হতে থাকে। ’৯০ সালে সে হয়ে ওঠে ঢাকার অপরাধ জগতের ভয়ংকর ডন। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় আসলাম। চলে যায় সুইডেন। খুনের প্রয়োজনে তাকে দেখা যায় ঢাকায়। খুন করেই উড়াল দেয় আকাশে। এভাবেই চলতে থাকে আসলামের অপরাধ জীবন। কিন্তু যুবলীগ নেতা গালিব খুনের পর তার মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয় লাখ টাকা। সরকারিভাবে পুরস্কার ঘোষণা করার পর তাকে গ্রেফতারের দায়িত্ব পরে তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসাইনের ওপর। এসি আকরামের বেশ কয়েকটি অভিযানও ব্যর্থ করে দেয় চতুর সুইডেন আসলাম। কিন্তু এসি আকরাম ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না।

সুইডেন আসলামকে গ্রেফতারে জাল বিছিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকার সর্বত্র। যে কোনো মূল্যে তাকে আটক করতেই হবে। ১৯৯৭ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহ। একটি সূত্রে খরব এলো সুইডেন আসলাম তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেই থাকছে। স্ত্রীর জন্য একটি নতুন ফ্রিজ কিনেছে ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি দোকান থেকে। এসি আকরাম ভাবলেন, এই ফ্রিজটি পৌঁছে দিতে পারে সুইডেন আসলামের কাছে। সত্যতা যাচাইয়ে কৌশলে তিনি স্টেডিয়াম মার্কেটের সেই দোকানের চার দিনের সেল রিপোর্ট ও মাল ডেলিভারির চালানের ঠিকানা সংগ্রহ করলেন। দোকান মালিক বা কর্মচারীদের কিছুই বুঝতে দেননি কোন ক্রেতার ঠিকানা খুঁজছেন। তিনি কাক্সিক্ষত ফ্রিজ ডেলিভারির একটি ঠিকানা সোর্সের দেওয়া এলাকার সঙ্গে মিল পেলেন। বিচক্ষণ পুলিশ অফিসার এসি আকরামের বুঝতে বাকি নেই ফ্রিজের এই ঠিকানায় লুকিয়ে আছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম।

১৯৯৭ সালের ২৫ মে। মহাখালী ডিওএইচএসের সেই বাড়িটিকে ঘিরে ফেলা হলো। এসি আকরামের সঙ্গে তার চৌকস কয়েকজন পুলিশ অফিসার। সবার সতর্ক দৃষ্টি সেই ফ্ল্যাটটির একটি কক্ষের দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ধরতে হবে। কারণ দুঃসাহসী সুইডেন আসলাম টের পেলে গুলি করতে পারে। তাই তাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না। ফ্ল্যাটটি আগেই ঘিরে ফেলা হলো। পালানোর সব পথেই সবার সতর্ক অবস্থান। ছাদের ওপর যাতে উঠতে না পারে সেখানেও গোয়েন্দাদের সতর্ক অবস্থান।

মহাখালী ডিওএইচএসের কাক্সিক্ষত সেই ফ্ল্যাটে নক করতেই ভিতর থেকে কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছিল না। বারবার কলিংবেল বাজানোর পরও যখন কেউ খুলছিল না, এসি আকরাম তখন নিজের পরিচয় দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলার কথা বলেন। এ-ও জানান পুলিশ তার ফ্ল্যাটের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এক পর্যায়ে সুইডেন আসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী দরজা খুলে দেন। সতর্কতার সঙ্গে এসি আকরাম অস্ত্র তাক করে রুমে প্রবেশ করে সুইডেন আসলামের হাতে আইনের শিকল পরিয়ে দেন। সেই সঙ্গে ঢাকায় অপরাধ জগতের এক ভয়ংকর খুনি সুইডেন আসলাম অধ্যায় শিকলবন্দী হয়।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর