৫ জুলাই, ২০২২ ১৪:০০

সাজা পরোয়ানা আড়াল করতে এক নেত্রীর আয়নাবাজি খেলা

মাহবুব মমতাজী

সাজা পরোয়ানা আড়াল করতে এক নেত্রীর আয়নাবাজি খেলা

আয়ানাবাজি শব্দটি বেশ পরিচিত। যাকে নিয়ে রহস্য তিনিও পরিচিত এবং আলোচিত একজন রাজনৈতিক নেত্রী। নিজের নামে থাকা সাজা পরোয়ানা তামিল যেন না হয় এ জন্য খেলেছেন আয়নাবাজি খেলা। রাজধানীর মিরপুর থানায় তানজিনা আক্তার সুমা নামে এক নারী প্রায় ১০ বছর আগের একাধিক পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকেন। দীর্ঘ সময়ে ওই নারীর খোঁজ পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তানজিনা আক্তার সুমার নামে থাকা একে একে ছয়টি সাজা পরোয়ানায় সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্টের চেয়ারম্যান লামিনাল ফিহা। তিনি লামিনাল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এক নামের পরোয়ানায় আরেক নামের নারী গ্রেফতারের বিষয়টি সামনে এলে বিভ্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তানজিনা আক্তার সুমা আর লামিনাল ফিহা একই নারী। দীর্ঘ পলাতক জীবনে তিনি যশ, খ্যাতি আর সুনাম কামিয়েছেন নাম পরিবর্তনের আয়নাবাজির খেলায়। এ ছাড়া তিনি আলোচিত একজন নারী উদ্যোক্তা এবং টেলিভিশনের পরিচিত মুখ। বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকা তার একাধিক ছবি দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। লামিনাল ফিহার পেছনের গল্প বের করতে চলে এক দীর্ঘ অনুসন্ধান।

সেই অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই আসামির নামে একাধিক পরোয়ানা। কিন্তু পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরোয়ানা তামিল না হওয়ায় তা ফিরে যায় আদালতে। এভাবেই কেটে গেছে প্রায় ১০ বছর। গত বছর নভেম্বরে তানজিনা আক্তার সুমা নামে এক আসামির মোট ছয়টি পরোয়ানা জমা হয় মিরপুর মডেল থানায়। আদালতে করা এসব মামলার মধ্যে ছিল ৬৬৭/১৩, ৬৬৩/১৩, ৬৬২/১৩ ও ৬৬১/১৩ মামলাগুলো। এর কিছুদিন পর চলতি বছরের শুরু থেকেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ সভায় একাধিক মামলার আসামির পরোয়ানা তামিলে বারবার তাগিদ দিতে থাকেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তানজিনার নামে ওই পরোয়ানার একটি ঠিকানা পাওয়া যায়। মিরপুর থানার দক্ষিণ পীরেরবাগের ১৯২/১ নম্বর বাড়িতে প্রায় ১২ বছর আগে ভাড়া থাকতেন আসামি তানজিনা। ওই সময় যিনি বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন তিনি এখনো আছেন। বাড়ির সামনে তার একটি ছোট্ট দোকানও আছে। লোকমান নামে ওই কেয়ারটেকার প্রথমে জানান, সপরিবার তানজিনা অনেক আগে বাসা ছেড়ে দিয়ে গেছেন। এখন কোথায় তিনি তা জানেন না। এরপর একে একে জমা হওয়া ছয়টি সাজা পরোয়ানার আসামিকে খুঁজে বের করতে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিরুর রহমানের নির্দেশনায় ফেব্রুয়ারি থেকে তদন্ত শুরু করেন একই থানার এসআই আনিসুর রহমান। পরোয়ানা কপিতে পাওয়া ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করেন এসআই আনিস। তিনি ধারাবাহিক যোগাযোগ রাখেন বাড়ির কেয়ারটেকার লোকমানের সঙ্গে। লোকমান একদিন এসআই আনিসকে জানান, তিনি তানজিনার খালাতো বোন রুবিকে দেখেছেন ওই এলাকা দিয়ে যেতে। কিন্তু রুবি কোথায় থাকেন তা তিনি জানেন না। কয়েক দিন পর রুবির মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন লোকমান। মোবাইলে যোগাযোগ করে রুবির সঙ্গে দেখা করেন এসআই আনিস। দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকাতেই থাকেন রুবি। তার স্বামী ইতালি প্রবাসী। রুবিকে এসআই আনিস জিজ্ঞাসা করেন, তানজিনার সঙ্গে যোগাযোগ হয় কি না? রুবি বলেন, ‘হ্যাঁ, ও তো তানজিনার বদলে লামিনাল ফিহা নামে বেশি পরিচিত।’ এরপর রুবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে ছবি বের করে এসআই আনিসকে দেখান। বর্তমান ছবি এবং আগের পাওয়া ছবির সঙ্গে অনেক মিল। মানুষও এক। কিন্তু বদলে ফেলা হয়েছে নামটুকু। তবে ছবি দেখে অনেকটা পিলে চমকে ওঠার মতো অবস্থা হয় এসআই আনিসের। কারণ লামিনাল ফিহা পরিচিত রাজনৈতিক নেত্রী এবং আলোচিত নারী উদ্যোক্তা। গত ঈদুল ফিতরে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি পুরো মিরপুর এলাকায় পোস্টারিং করেছেন। এরপর তানজিনার বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার দুই বাদী ইমরান ও বিল্লালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এসআই আনিস। তবে ইমরান কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেননি। মগবাজারে থাকা বিল্লালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তার সঙ্গে জমি নিয়ে প্রতারণা করেন তানজিনা। তাকে দেওয়া একটি জমির দলিলে তানজিনার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়। সেটিও সংগ্রহ করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আনিস। সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের পর ২৪ জুন রাজধানীর পল্লবীর স্বপ্ননগর আবাসিক এলাকা থেকে তানজিনা ওরফে লামিনাল ফিহাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ। মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাজা পরোয়ানাভুক্ত ওই আসামি পলাতক থাকার জন্য নানা কৌশল নিয়েছেন, নামও পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু আইনের চোখে ধুলো দিয়ে কেউ বেশি দিন কোনো কিছু করে থাকতে পারে না, যেটি আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি।’
পুলিশের তদন্তে দেখা যায়, ২০১০ সালের দিকে দুবাই চলে যান তানজিনা। সেখানে কয়েক বছর থেকে দেশে ফিরে এসে দেখেন তার নামে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৮টি মামলা হয়েছে। মামলা থেকে বাঁচতে এবং গ্রেফতার এড়াতে অ্যারাবিক নাম লামিনাল ফিহা ধারণ করে নারীনেত্রী বনে যান তিনি। ২০০৮ সালে তিনি একটি জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন করেছিলেন। এখানে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন তানজিনা, পিতা মাজহারুল ইসলাম, মাতা রুমা, স্বামী রাফি চৌধুরী, জন্মতারিখ ১৩ আগস্ট ১৯৮৭ সাল। বর্তমান ঠিকানা ছিল ১৯২/১ দক্ষিণ পীরেরবাগ, মিরপুর। স্থায়ী ঠিকানায় উল্লেখ করেন, কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মানিককান্দি গ্রাম। ২০১৭ সালে আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্র করেন তিনি। সেখানে নিজের নাম দিয়েছেন লামিনাল ফিহা, পিতা এম ইসলাম, মাতা রুমা ইসলাম, জন্মতারিখ ১৩ আগস্ট ১৯৮৯ সাল। আর এখানে নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করেছেন। এটি করার সময় তিনি একটি এসএসসি পাসের সার্টিফিকেটের কপি দেন। কিন্তু মূলত তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন।

লামিনাল ফিহা সম্পর্কে আরও যা জানা যায় : অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৩৯ দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট’ নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে লামিনাল ফিহাকে চেয়ারম্যান করে এই রাজনৈতিক দল ও কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। একই বছর ১৫ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে একটি চিঠি দেন ফ্রন্টের চেয়ারম্যান লামিনাল ফিহা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর