শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অন্ধত্বের কাছে হার মানেননি অদম্য রোকেয়া

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

অন্ধত্বের কাছে হার মানেননি অদম্য রোকেয়া

তাম্বুলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিউলী দাস বলেন, রোকেয়া যখন এ বিদ্যালয়ে এসে যোগ দেন আমরা তখন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি কীভাবে ক্লাস নেবেন, এলাকার লোকই বা বিষয়টি কীভাবে দেখবে। তবে রোকেয়া বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর তার দক্ষতা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অনেক মেধাবী রোকেয়া। সহজেই সব কিছু রপ্ত করে নিতে জানেন। আমরা বোঝার আগেই বুঝে যান। এই স্কুলে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই রোকেয়া আমাদের আপনজন হয়ে ওঠেন।

 

চোখে দেখতে পান না। কিন্তু নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় ফরিদপুর সদরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ইতিমধ্যেই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তিনি যখন ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন তার সহকর্মীরা একটু বিপদেই ছিলেন এই ভেবে, ‘একে তো চোখে দেখতে পান না, কী পড়াবেন, কীভাবে নেবেন ক্লাস’। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই সহকর্মীদের ভুল যায় ভেঙে। অন্ধত্বের কাছে হার না মানা অদম্য এই শিক্ষকই হলেন রোকেয়া বেগম (২৮)। রোকেয়া বেগম ফরিদপুর সদর উপজেলার তাম্বুলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর। তিনি ওই বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ান।

‘প্রথম প্রথম আমাকে একটু বেগ পেতেই হয়েছিল, শিশুরা আমাকে দেখে ভয় পেত’- মন্তব্য করে রোকেয়া বলেন, তবে অল্পদিনের মধ্যেই আমি ওদের আপন করে নেই। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গান গেয়ে নানা ছড়া, কবিতা বলে আমি ওদের মন জয় করে নিয়েছি। এখন আমার বাড়িতে সময় কাটে না। সারারাত শুধু একই চিন্তা, কখন সকাল হবে, কখন স্কুলে যাব।

সম্প্রতি রোকেয়ার ক্লাস নেওয়া দেখতে তাম্বুল খানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাস নিচ্ছেন রোকেয়া। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সব শিশু গোল হয়ে রোকেয়াকে ঘিরে বসেছে। রোকেয়া পড়াচ্ছেন, ‘স্ব-রে অ- অয় অজগর আসছে তেড়ে, স্ব-রে আ আমটি আমি খাব পেড়ে।’ কথা শেষ করেই রোকেয়া মাটির তৈরি আম ধরে দেখিয়ে শিশুদের শেখাচ্ছেন। পাশাপাশি শেখাচ্ছেন প্রতিশব্দও অ তে অজগর, আবার অ-তে অলংকার। অলংকার বুঝাতে রোকেয়া নিজের গলার মালা, কানের দুল দেখিয়ে শেখাচ্ছেন। রোকেয়া কোনো প্রশ্ন করতেই শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে উত্তর দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশ। ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আরাফাত জানায়, আপা ভালো পড়ায়। আপা বলে যায় আমরা তার সঙ্গে সঙ্গে বলি। একই শ্রেণির শ্রীজিৎ শিল বলে, আপা খেলা করতে করতে পড়ায়। পড়ানোর সময় বিভিন্ন ছবি দেখায়। একই শ্রেণির মনখুশী সিং বলে, আপার পড়ানো ভালো লাগে। গান ও ছড়া করে পড়ায়। পড়া না পারলে শিশুদের মারেন কি? প্রশ্ন করা হলে জিহ্বা বের করে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ‘না’, ‘না’ ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে রোকেয়া বলেন, ‘কেন আমি ওদের মারব, ওরা তো আমার সন্তানের মতো’। ফরিদপুর সদরের তাম্বুলখানা এলাকার রোকেয়া বেগমের জন্ম ১৯৯২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। তার বাবা মুজিবুর রহমান মারা যান ১৯৯৫ সালে। তার দুই বছর পর মারা যান মা হাসিনা বেগম।

পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রোকেয়া চতুর্থ। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর বড় বোন শাহানাজ বেগম (৪৩) রোকেয়াসহ অন্য ভাইবোনদের দায়িত্ব নেন। দ্বিতীয় বোন মর্জিনা আক্তার বিবাহিত শ্বশুর বাড়িতে। একমাত্র ভাই রফিক শেখ (২৩) পড়াশোনা করেনি।

রোকেয়া বেগম ছাড়াও তার তৃতীয় বোন শিখা ও ছোট বোন আছিয়া পড়াশোনা করছেন। শিখা ঢাকার ইডেন কলেজে সমাজবিদ্যা বিষয়ে

মাস্টার্স করছেন এবং আছিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স করছেন ।

ছয় ভাই বোনের মধ্যে পড়াশোনা করেছেন রোকেয়া, শিখা ও আছিয়া। এই তিন বোনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে তাদের প্রতিবন্ধীকতা জন্মগত নয়। রোকেয়ার চার বছর, শিখার নয় বছর ও আছিয়ার সাত বছর বয়সে তারা একে একে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। ২০০০ সালে ঢাকার ইসলামিয়া হাসপাতালে এই তিন বোন চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানায়, তাদের মা ও বাবা খালাতো ভাইবোন হওয়ায় রক্তের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এ রোগ নিরাময় যোগ্য নয়।

ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম এ সামাদের সহযোগিতায় এই তিন বোন ঢাকার মিরপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। ওই মিশনের হোস্টেলে থেকে মিরপুর আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকার বদরুননেসা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর রোকেয়া ইডেন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সে শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে অংশ নিয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন।

তাম্বুলখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিউলী দাস বলেন, রোকেয়া যখন এ বিদ্যালয়ে এসে যোগ দেন আমরা তখন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি কীভাবে ক্লাস নেবেন, এলাকার লোকই বা বিষয়টি কীভাবে দেখবে। তবে রোকেয়া বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর তার দক্ষতা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অনেক মেধাবী রোকেয়া। সহজেই সব কিছু রপ্ত করে নিতে জানেন। আমরা বোঝার আগেই বুঝে যান। এ স্কুলে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই রোকেয়া আমাদের আপনজন হয়ে ওঠেন।

আরেক সহকারী শিক্ষক রুমা বর্মণ বলেন, আমি আমার ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি রোকেয়াকে সাহায্য করি। শিক্ষার্থীদের হাজিরা দিয়ে দেই। বোর্ডে কিছু লেখার প্রয়োজন হলে লিখে দেই। রোকেয়ার পড়ানোর স্টাইল ও একাগ্রতা দেখলে মনেই হয় না ও দুই চোখে দেখতে পারে না।

প্রধান শিক্ষক কাকলী রানী সাহা বলেন, রোকেয়া মিশুক ও অসাধারণ ভালো মানুষ। জানার স্পৃহা বেশি। স্কুলের সময় দারুণভাবে মেনে চলে। তিনি বলেন, রোকেয়া ব্রেইল পদ্ধতির বই দিয়ে শিশুদের পাঠ দেন। পাঠদানের প্রতিটি বই রোকেয়াকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বারতি খরচ করে সংগ্রহ করতে হয়। এ বিষয়টি সরকারিভাবে দেখা গেলে ভালো হয়। এ ছাড়া প্রাইমারি শিক্ষকদের যে ট্রেনিং হয় পিটিআইতে সেখানেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বইয়ের ব্যবস্থা করার দরকার। কেননা ট্রেনিংয়ের সব বিষয় একবারে মনে থাকার কথা নয়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, আমি নতুন যোগদান করেছি। রোকেয়ার স্কুলটি এখনো আমার ভিজিট করা হয়নি বিধায় রোকেয়া সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শিব পদ দে জানান, ‘রোকেয়ার পারফরমেন্স ভালো। গান গেয়ে হাত তালি দিয়ে পড়িয়ে ক্লাস মাতিয়ে রাখেন।’ তিনি বলেন, ওর জন্য যাতে ব্রেইল পদ্ধতির বই সরকারিভাবে সরবরাহ করা যায় সে চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বই সংযুক্ত করার জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিতে যোগাযোগ করা হয়েছে। এদিকে শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইতিমধ্যেই রোকেয়া বেগমকে প্রথমে ফরিদপুর জেলায় পরে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়ীতার সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর