রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিস্ময় বিশ্ব

জেমস ডিনের অভিশপ্ত গাড়ি

রণক ইকরাম

জেমস ডিনের অভিশপ্ত গাড়ি

তার পুরো নাম জেমস বায়রন ডিন। তবে জেমস ডিন নামেই তিনি বেশি পরিচিত। ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘রিবেল উইদাউট এ কারস’ আশাতীত সাফল্য পায়। এই এক সিনেমার মাধ্যমেই তারকা খ্যাতি পান জেমস ডিন। এর আগে মাত্র দুটি ছবিতে মূল ভূমিকা ও কিছু টিভি সিরিজে অভিনয় করেন তিনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর প্রায় ছয় দশক পরও তাকে হলিউড আইকন হিসেবে গণ্য করা হয়। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেরা ১০০ নায়কের তালিকায় উপরের দিকে তার স্থান। মার্কিন চলচ্চিত্র জগতে এযাবৎকালের সেরা ১০০ নায়কের মধ্যে জেমস ডিন ১৮-তে অবস্থান করছেন। তবে এই খ্যাতি একেবারেই অল্প সময়ে অর্জন করেন তিনি। অভিনয় জীবনের পাঁচ বছরের মাথায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। ডিনের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে তার পছন্দের একটি গাড়ি ও অতি অল্প বয়সে মৃত্যুকে ঘিরে ঘনীভূত হওয়া রহস্য।

জেমস ডিনের অভিনয় প্রতিভার বাইরে আরেকটি পরিচয় ছিল। তিনি কার রেসিং পছন্দ করতেন। সেলিব্রেটিরা সেই আমল থেকেই দামী স্পোর্টস কার কিনে কাস্টমাইজ করে নিতেন। যেহেতু ডিন রেস পাগল ছিলেন-তার গাড়িপ্রীতি থাকাটাই স্বাভাবিক। তখন ডিন সবে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পোর্শে স্পাইডার-এর তিনটি গাড়ি আসে। রেস পাগল ডিন এর একটিকে নিজের করে নেন। পোর্শে স্পাইডার [Porsche 550 Spyder] জার্মানির খ্যাতনামা গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পোর্শের সেরা স্পোর্টস কারের মধ্যে অন্যতম। স্পাইডারকে বিশেষভাবে রেসের জন্যই ডিজাইন করা হয়েছিল। আবার ব্যাট মোবাইল ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত জর্জ ব্যারিস দিয়ে গাড়িটিকে কাস্টমাইজ করে নেন ডিন। আপাদমস্তক স্টাইলিশ ডিন গাড়ি সাজাতে কোনো কার্পণ্য করেননি।

গাড়িতে টারটান সিট, রেয়ার হুইলের ওপর লাল স্ট্রাইপ এবং ১৩০ নম্বরটি দরজা, হুড ও এনজিন কভারের ওপর লেখা হয়। আদর করে গাড়িটির নাম দেওয়া হয় লিটল বাস্টার্ড। তখনো কি কেউ ভেবেছিল এই নামটি এমন করে যথার্থ হয়ে উঠবে?

অল্প দিনের জন্য হলেও সিনেমার পাশাপাশি বিভিন্ন রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন ডিন। কার রেসিং-এ তার অর্জনও কম ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়ায় এমনই এক প্রতিযোগিতায় ‘লিটল বাস্টার্ড’-কে নিয়ে ট্র্যাকে যাচ্ছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে পোর্শের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় ক্যালিফোর্নিয়ার  স্টেট রুট ৪৬ সড়কের একটি বাঁক পার হচ্ছিলেন জেমস। ওয়ারেন বেথের লেখা ‘দি ডেথ অব জেমস ডিন’ বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রবার্ট হোয়াইটের বর্ণনায় আছে, জেমস ডিনের গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। অপর দিক থেকে আসা গাড়িটি ছিল ফোর্ড-এর একটি রেসিং কার। যার চালক ছিলেন ২৩ বছর বয়সী ডোনাল্ড টার্নস্পিড। পলোনিও পাসর কাছে বাঁক নেওয়ার সময় অসাবধানতাবশত মুখোমুখি পড়ে যায় তীব্র গতিতে আসা গাড়ি দুটি। সামলানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি।

রবার্টের বর্ণনা অনুসারে, সংঘর্ষের পর জেমসের গাড়ি দুবার ডিগবাজি দিয়ে রাস্তার ধারে খাদে আছড়ে পড়ে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, লিটল বাস্টার্ড-এর সেদিন আলাদাভাবে রেসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডিন নিজে তার মেকানিককে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। রেসিং গ্রুপের বাকিদের বলা হয় স্টেশন ওয়াগনে করে রওনা দিতে। আদতে সেই গাড়িতে ডিনের থাকার কথা ছিল। এরপরই বিকালে সেই দুর্ঘটনা। হাসপাতালে নেওয়ার পথে ডিনের মৃত্যু হয়। মেকানিক রলফ সেই যাত্রা প্রাণে বাঁচলেও পরবর্তীতে আরেকটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ঘটনা এটুকু থাকলে ভাবাই যেত নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু এর আগের ও পরের ঘটনাগুলো মিলালে শিউরে উঠতে হবে। প্রবল বিজ্ঞানমনস্করাও ভাবতে বাধ্য হবেন আসলেই অভিশাপ বলে কিছু আছে!

গাড়ি কেনার মাত্র ৯ দিনের মাথায় যখন ডিনের মৃত্যু হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে ডিনের জীবদ্দশায় অনেকেই তাকে এই গাড়ির অশুভ শক্তির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তারকা অভিনেতা এলেক গিনেস, অভিনেত্রী উরসুলা আন্দেস, আর্থা কিট, নিক এডামস, মাইলা নুর্মি প্রমুখ। এলেক গাড়িটি দেখেই একে অলক্ষুুণে বলে অভিহিত করেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ডিন এ গাড়ি বর্জন না করলে এই গাড়িতেই এক সপ্তাহের মাথায় তার মৃত্যু হবে। বলা বাহুল্য এই ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে মিলে গিয়েছিল। অভিনেত্রী উরসুলা আন্দ্রেস ছিলেন ডিনের তখনকার গার্লফ্রেন্ড। তিনি ডিনের অনুরোধ সত্ত্বেও এই গাড়িতে কখনো চড়েননি। বাকিরা সবাই গাড়ির আশপাশে থাকাকালীন সময়ে অস্বস্তিকর  অনুভূতির কথা বর্ণনা করেন। ডিনের আপন চাচা চার্লি নোলান ডিনের মৃত্যুর কিছু সময় আগেও তাকে গাড়িটির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। সবাই কেন এভাবে বলেছিল। পরবর্তীতে সবাই বলেছেন অনুভূতি। এই গাড়ির আশপাশে থাকা অবস্থায় কেউই ভালো অনুভব করেননি। মনের ভিতর কিসের যেন খটকা লেগেছে। আর সে কারণেই এভাবে সতর্ক করা। তখনো তারা ভেবেছিলেন এমন একটি দুর্ঘটনা সত্যি ঘটে যাবে!

সেই দুর্ঘটনার পর জর্জ ব্যারিস নামের এক লোক ওই সময়ের প্রায় ২৫০০ ডলার খরচ করে লিটল বাস্টার্ড-এর ধ্বংসস্তূপ কিনে নেন। এরপর তিনি যতটুকু সম্ভব এর যন্ত্রাংশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। তার মালিকানায় থাকাকালীন সময়ে দুই চোর গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল আর সিট কভার চুরির প্রচেষ্টা চালায়, পরিণতিতে একজনের হাত মারাত্মকভাবে কেটে যায়, অপরজন আহত হন।

ব্যারিস গাড়ির ইঞ্জিন ও অন্যান্য পার্টস ডাক্তার উইলিয়াম ও ট্রয় নামের দুজন রেসপ্রেমীর কাছে বিক্রি করেন। এর ১৩ মাস পর সেই অশুভ যন্ত্রাংশ লাগিয়ে রেসিং এর সময় ডাক্তার উইলিয়াম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। একই দিনে ডা. ট্রয় অন্য একটি রেসে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন এবং কোনোমতে বেঁচে যান। তার গাড়িতে পোর্শের ইঞ্জিন লাগানো ছিল। ডিনের গাড়ির অক্ষত দুটি চাকার দুর্ভাগা মালিকও একই সময়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন।

পরে ব্যারিস দুমড়ানো গাড়ির বডিকে বৃহত্তর লস অ্যাঞ্জেলস সড়ক নিরাপত্তা পরিষদকে ধার দেন প্রদর্শনীর জন্য। এখানেও বাধে বিপত্তি। প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাকের ড্রাইভার রহস্যজনকভাবে ডিনের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যান। এরপর গাড়ির প্রথম প্রদর্শনী ব্যর্থ হয় যখন এটি স্টোরেজে থাকা অবস্থায় আপনাআপনি গ্যারেজে আগুন ধরে যায়। অন্য সব পুড়ে গেলেও গাড়িটিকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে একটি হাই স্কুলের প্রদর্শনীতে ডিনের গাড়ি ডিসপ্লে থেকে পড়ে যায়। এতে কাছাকাছি থাকা এক শিক্ষার্থী আহত হয়।

একের পর এক দুর্ঘটনা জন্ম দেওয়ার কারণে বৃহত্তর লস অ্যাঞ্জেলস সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ গাড়িটিকে ব্যারিসের কাছে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে পরিবহনের সময় গাড়িটি উধাও হয়ে যায়। এরপর আর কখনো এর দেখা মেলেনি।

অনেকের বিশ্বাস, জেমস ডিনের গাড়ির অভিশাপের কারণে কেবল তারই মৃত্যু হয়নি বরং ক্ষতিগ্রস্ত করেছে গাড়িটির সংস্পর্শে থাকা অনেকেরই। ডিনের সর্বশেষ সিনেমা রিবেল উইদাউট এ কারস-এর মূল ভূমিকায় থাকা তিনজনেরই অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছিল। ডিনের ভালো বন্ধু স্যাল ম্যারিনো মাত্র ৩৭ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় মারা যান। ট্র্যাজিক বোটিং অ্যাক্সিডেন্টে ৪৩ বছর বয়সে মারা যান আরেক কো-আর্টিস্ট নাটালি উড। ৩৬ বছর বয়সে ওষুধের ওভারডোজে মারা যান নিক এডামস।

ডিনকে সবাই পছন্দ করত এবং ভালোবাসত। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। এখন প্রশ্ন হলো ডিনের প্রিয় স্পাইডার যদি অভিশপ্ত হয়েই থাকে, তাহলে কোত্থেকে এলো সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ? কেউ কি ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছিল ডিনের সেই গাড়িটিকে? নাকি এটাই ছিল ডিনের নিয়তি? নাকি গাড়িটিই ছিল কোনো শয়তান? কিন্তু ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করে এমন একটি শয়তান সম্প্রদায়ের সঙ্গে জেমস ডিনের সম্পৃক্ততা ছিল? ডিন অতিপ্রাকৃত বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন।

এসব জাদুবিদ্যা নিয়ে এদের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো ডিনের। এর মধ্যেই ভ্যাম্পিরা নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা মাইলা নরমি নামের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে গোপন সম্পর্কে জড়ান জেমস। তার সঙ্গে একাধিকবার ডেটিংও করেন ডিন। এ বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন ডিন। কারণ তার ধারণা ছিল এটি প্রকাশ হয়ে পড়লে তার ক্যারিয়ারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

সব দিক চিন্তা করে ডিন তার সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখার জন্য জাদুবিদ্যার সাহায্য নিতে চাইলেন। সে কারণেই এদের সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ করতেন ডিন। যেহেতু মাইলা নরমির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছা ডিনের ছিল না, সেহেতু জনসম্মুখে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। ওই সময়ের জনপ্রিয় গসিপ কলামিস্ট হেড্ডা হোপের সঙ্গে ইন্টারভিউতে মাইলা নরমির সঙ্গে ডেট করার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন ডিন। এ বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেননি মাইলা নরমি। অনেকের ধারণা এরপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মাইলা নরমি ব্ল্যাক ম্যাজিকের আশ্রয় নেন। কেউ কেউ বলেন নরমি নিজেই ব্ল্যাক ম্যাজিক জানতেন। আবার এমনো হতে পারে তিনি হয়তো ব্ল্যাক ম্যাজিক জানা অন্য কোনো ডাইনির সহযোহিতা নিয়েছিলেন। তবে এসবই কিন্তু জল্পনা-কল্পনা। এসব তথ্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। মাইলা নরমি নিজেও প্রকাশ্যে এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।

ঘটনা যাই হোক না কেন জেমস ডিনের মৃত্যু এত বছর পরও মানুষকে কাঁদাচ্ছে। রহস্যময় গাড়িটি সেই যে উধাও হয়েছে আর সেটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছে সেই গাড়িটি? কোথায় তার ভিতরের অভিশপ্ত প্রেতাত্মা?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর