দয়ামায়া মানুষের সহজাত একটি বিষয়। আল্লাহ মানুষের প্রতি মানুষের দয়া ও অনুগ্রহের মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছেন। এই দয়া-মায়ার স্পর্শ ছাড়া এই পৃথিবী, এই জগৎ-সংসার অচল হতে বাধ্য। দয়া অনুগ্রহ আল্লাহতায়ালার মহান গুণাবলির অন্যতম। সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের এক বহিঃপ্রকাশ মুহাম্মদ (সা.)। তিনি মানবজাতির প্রতি দয়া করেছেন। তিনি রসুলুল্লাহ (সা.) কে জগদ্বাসীর প্রতি রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন- ‘হে নবী, আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি’ (সুরাতুল আম্বিয়া-১০৭)। তাই রসুল (সা.) নিজেও প্রায়ই বলতেন, ‘হে মানুষেরা, নিশ্চয়ই আমি উপহার হিসেবে প্রদত্ত এক রহমত’ (সুনানে দারেমি-১৫)।
নবীজি (সা.)-এর দয়া সব মানুষের জন্য সমান ও ব্যাপক, বিশেষত এই উম্মতের জন্য। একটি হাদিসে নবীজি (সা.) নিজেই নিজের দয়া-অনুগ্রহের বিষয়টি চমৎকার উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি রসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছেন, আমার ও লোকদের উদাহরণ এমন লোকের মতো, যে আগুন জ্বালালো আর যখন তার চারদিক আলোকিত হয়ে গেল, তখন পতঙ্গ ও ওই সমস্ত প্রাণী যেগুলো আগুনে পোড়ে, তারা তাতে পুড়তে লাগল। তখন সে সেগুলোকে আগুন থেকে ফিরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেগুলো আগুনে তাকে পরাজয় করল এবং আগুনে পতিত হলো। (তদ্রুপ) আমিও তোমাদের কোমর ধরে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমরা তাতেই পতিত হচ্ছ (সহিহ বুখারি)।
এমন অপূর্ব দয়া ও মমতার নিদর্শন আপনি আর কোথায় পাবেন? পৃথিবী এমন দয়া-মায়ার দৃষ্টান্ত পেশ করতে অক্ষম। নবীজি (সা.) এমন সীমাহীন দয়া-মায়ার স্পর্শ ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, কাছে-দূরের, বন্ধু-বান্ধব এমনকি শত্রুর জন্যও অবারিত ছিল। তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ নির্দিষ্ট কোনো কাল, সময় বা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাঁর দয়ার চাদর জিন-ইনসান জীব-জড় সব কিছুর মাঝেই বিস্তৃত ছিল। তাই তিনি তাঁর প্রিয় উম্মতকেও দয়ার গুণ অর্জনের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে দয়ালু ও স্নেহপরায়ণদের প্রতি দয়া করেন’ (সহিহ বুখারি)। নবীজি (সা.)-এর প্রতিটি কথা ও কাজে দয়া ও মমতার অনন্য নিদর্শন ফুটে উঠত। বয়স্ক ও ছোটদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর দয়ার কথা নিম্নোক্ত হাদিসে বড় চমৎকার করে ফুটে ওঠে। যারবি (রহ.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আনাস ইবনু মালিক (রা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, একজন বয়স্ক লোক রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে আসে। লোকেরা তার জন্য পথ ছাড়তে বিলম্ব করে। (তা দেখে) রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে লোক আমাদের শিশুদের আদর করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় (জামে তিরমিজি)। কী চমৎকার শিক্ষা! আদর্শ সমাজ গঠনে কী অসাধারণ কার্যকরী নির্দেশনা! নবীজি (সা.)-এর কাছে কোনো অপরাধী এসে অপরাধ স্বীকার করলে তিনি তাঁর প্রতিও দয়া ও সহানুভূতিমূলক আচরণ করতেন। নবীজি (সা.)-এর পবিত্র সিরাতে এ জাতীয় ঘটনা প্রচুর রয়েছে। আমরা সে দ্যুতিময় ঘটনাবলির একটি উল্লেখ করছি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসুল (সা.)-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। রসুল (সা.) বললেন, তোমার কী হয়েছে? সে বলল, আমি সিয়াম অবস্থায় আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। রসুল (সা.) বললেন, আজাদ করার মতো কোনো ক্রীতদাস তুমি মুক্ত করতে পারবে কি? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি একাধারে দুই মাস সিয়াম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। এরপর তিনি বললেন, ষাটজন মিসকিন খাওয়াতে পারবে কি? সে বলল, না। তখন নবী (সা.) থেমে গেলেন, আমরাও এ অবস্থায় ছিলাম। এ সময় নবী (সা.)-এর কাছে এক ‘আরাক’ পেশ করা হলো যাতে খেজুর ছিল। ‘আরাক হলো ঝুড়ি। নবী (সা.) বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে সদাকাহ করে দাও। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রসুল! আমার চাইতেও বেশি অভাবগ্রস্তকে সদাকাহ করব? আল্লাহর শপথ, মদিনার উভয় লাবা অর্থাৎ উভয় প্রান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবগ্রস্ত কেউ নেই। রসুল (সা.) হেসে উঠলেন এবং তাঁর দাঁত (আইনয়াব) দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেন, এগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও (সহিহ বুখারি)। কী অসাধারণ সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ! কোনো ধরনের ক্রোধ বা ক্ষোভের প্রকাশ ছাড়াই তিনি বারবার লোকটিকে কাফফারা আদায়ের উপায় বলে দিচ্ছিলেন। তাঁর বিষয়টিকে মৃদু হেসে সহজ-স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন, যা অপরাধীকে এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি দেয়। ইবাদতের ক্ষেত্রেও নবীজি (সা.) তাঁর দয়ার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে অভিযোগ করে বলেন, অমুক ইমাম নামাজ দীর্ঘ করে। এতে আমার কষ্ট হয়। এ কথা শুনে নবীজি (সা.) ইমামের ওপর রাগ করেন।
আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক সাহাবি এসে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! অমুক ব্যক্তির জন্য আমি ফজরের সালাতে অনুপস্থিত থাকি। কেননা, তিনি আমাদের সালাত খুব দীর্ঘায়িত করেন। এ কথা শুনে রসুল (সা.) রাগান্বিত হলেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, নসিহাত করতে গিয়ে সেদিন তিনি যেমন রাগান্বিত হয়েছিলেন, সে দিনের মতো রাগান্বিত হতে তাঁকে আর কোনো দিন দেখিনি। অতঃপর তিনি বললেন, হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যে বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকারী রয়েছে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ লোকদের ইমামতি করে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা, তার পেছনে দুর্বল, বৃদ্ধ ও হাজতওয়ালা লোকেরা রয়েছে (সহিহ বুখারি)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখজানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর