সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পুকুর খননের আড়ালে মাটি বিক্রির মচ্ছব

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীর হোজা বিলের মাঝের রাস্তাটি কার্পেটিং করা হয় প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু এ বছর বর্ষা পার হওয়ার আগেই রাস্তাটি ভেঙে গেছে মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের চলাচলে। বিলের মাঝে একের পর এক খনন করা হচ্ছে পুকুর। আর সেই পুকুরের মাটি চলে যাচ্ছে ট্রাক্টরে করে দূর-দূরান্তে। ট্রাক্টরে বহন করা মাটি রাস্তায় পড়ে লেপ্টে যাচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলেই সে মাটিতে গোটা সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। আবার ভারী ট্রাক্টরের অবাধ যাতায়াতে রাস্তা ভেঙে হয়েছে চৌচির। হোজা বিলের চারদিকে যেদিকে চোখ যায় শুধু পুকুর আর পুকুর। গত শীত থেকে শুরু করে এখনো বিলের কোনো কোনো স্থানে পুকুর খনন চলছে। রাজশাহীর দুর্গাপুরের শুধু এই বিলে নয়, আশপাশের উজানখলশি, নওপাড়া, দাওকান্দিসহ বাগমারা, পবা, মোহনপুর, তানোর, পুঠিয়া ও চারঘাটে এবার পুকুর খনন হয়েছে বা হচ্ছে। আর এতে গ্রামের নতুন-পুরনো কার্পেটিং রাস্তা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ব্যাপক হারে হারিয়েছে কৃষিজমি।

আবার আগামী বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক হারে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে শুধু পুকুর খননের জন্য বাগমারায় বন্যা দেখা দেয়। এ বছরও বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাগমারাসহ দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, চারঘাট ও তানোরে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর বিভিন্ন বিলে এ বছর অন্তত ১ হাজার পুকুর খনন হয়েছে। কেবল দুর্গাপুরেই অন্তত ৬০০ পুকুর খনন হয়েছে বিভিন্ন বিলে। আর এসব পুকুর খননের পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কোনো অনুমতি ছাড়াই পুকুরগুলো খনন হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। এতে স্থানীয় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে শতাধিক লিখিত অভিযোগ জমা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার কখনো কখনো লোকদেখানো পুলিশ গিয়েও আবার ফিরে এসেছে। দুই-একটা জায়গায় অভিযান চালাতেও দেখা গেছে। কিন্তু বন্ধ করা যায়নি পুকুর খনন।

পবার একটি বিলের মাঝে অন্তত ৪০ বিঘা জায়গা দখল করে পুকুর খনন করছেন পারিলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন ও হরিয়ান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু। তারা দুজনেই আওয়ামী লীগ নেতা। এ নিয়ে এলাকাবাসী প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি। বরং দুই নেতার দাপটে তটস্থ হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।

স্থানীয় আকবর হোসেন বলেন, ‘প্রতিবাদ করেছি। কোনো লাভ হয়নি। তারা আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এভাবে এ উপজেলায় চলতি বছরে শতাধিক পুকুর খনন হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে করে কৃষিজমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি পুকুর খননের মাটি পরিবহনের জন্য নতুন-পুরনো গ্রামীণ রাস্তাগুলো ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে বসে আছে।’

দুর্গাপুরে জুগিশো গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘চোখের সামনেই খেতের জমি কেটে পুকুর হয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলার নাই। শুধু আওয়ামী লীগের লোকজনকে ম্যানেজ করে প্রশাসনকে কিছু টাকা দিয়ে এলেই পুকুর কাটা হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি।’

রাজশাহীর বাগমারার মাঝিড়া গ্রামের মাজিদুল বলেন, ‘বাগমারাজুড়েই পুকুরে ভরে গেছে। অন্যান্য বার প্রশাসন ব্যাপক বাধা দিত। ফলে পুকুর খনন হলেও এতটা করার সাহস পেত না। কিন্তু এবার কোনো বাধা না থাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে যথেচ্ছাচার পুকুর খনন হয়েছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি। অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।’

রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, ‘পুকুর খনন নিয়ে কিছু বলার নেই। বাধা দিয়েও কোনো লাভ হয় না। আর জমি যার, তিনি তার অধিকার রাখেন সেখানে কি করবেন।’

সর্বশেষ খবর