চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা ঘুম থেকে ওঠার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যান। এতে তার হাতের গিরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। চিকিৎসার জন্য তিনি গেলেন একজন হাতুড়ে হাড়ভাঙা চিকিৎসকের কাছে। তিনি হাতটা প্লাস্টার করে দিলেন। কিন্তু তাতে হাতটা ভালো হয়নি। পরে বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক্সের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এভাবে গ্রাম-শহরের মানুষ সমানেই অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। এতে করে হচ্ছে ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা। রোগে বাড়াচ্ছে ঝুঁকি। কিন্তু সঠিকভাবে সঠিক সময়ে এসব রোগের চিকিৎসা শুরু না করলে রোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করার শঙ্কা থাকে। তবে দেশে এখনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেফারেল ব্যবস্থা তেমন প্রচলিত হয়নি। অপচিকিৎসার এটিও একটি কারণ। অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার মধ্যে আছে- ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া, হাতুড়ে চিকিৎসকের চিকিৎসা নেওয়া, অনিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া, নিজেই নিজের চিকিৎসা করা, ওষুধ কিনে খাওয়া এবং কবিরাজ, ওঝার ঝাড়ফুঁক, বিভিন্ন অবাস্তব প্রথা-কুসংস্কার বিশ্বাস করা। সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এক গবেষণায় বলছে, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ওষুধের দোকান, হাতুড়ে চিকিৎসক ও নিজে নিজে চিকিৎসা গ্রহণ করে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ। ৬০ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ওঠে আসে। করোনার সময়ও ৯৮ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন বলে গবেষণায় বলা হয়। চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রফিক্যাল মেডিকেল ইনফেকসাস ডিসিজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা মানেই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এটি সুষ্ঠু চিকিৎসার বড় অন্তরায়। প্রতিনিয়তই এ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। চিকিৎসকের কাছে আসার আগেই নিজ দায়িত্বে এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন জরুরি ওষুধ সেবন করে ফেলে। গ্রাম পর্যায় কিংবা অনুন্নত এলাকা তো বটেই, অনেক শিক্ষিত মানুষও ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। এতে করে রোগ বাড়ে, রোগীর অবস্থা খারাপ হয়, রোগ নিরূপণে সমস্যা তৈরি হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. অজয় দেব বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার বড় ক্ষতিকর দিক হলো জীবনরক্ষাকারী এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার। ফার্মেসিগুলো না বুঝে একসঙ্গে কয়েকটি এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে অন্য ওষুধও দিচ্ছে। আবার হুট করে ওষুধ পরিবর্তন করবে। এগুলো রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতি। যেমন- একজন গর্ববতী মা কিংবা দুগ্ধপানকারী মাকে যেমন ইচ্ছা ওষুধ দেওয়া যাবে না। এতে গর্বের সন্তান নষ্ট কিংবা বুকের দুধ কমে যাওয়া বা দুধ না পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই সবারই উচিত অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা না নেওয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ কিনে খাওয়ার মাধ্যমে বিপদ আসে। সঠিক রোগ নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ না করার কারণে রোগ শনাক্ত করা থেকেও বঞ্চিত হয়। কিন্তু অনেক সময় চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ প্রটোকল না মানা, অজ্ঞাত অসুস্থতা বা অসুখ চিহ্নিত করতে না পারা, ঝাড়ফুঁক বা অযোগ্য-অনভিজ্ঞ হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ শারীরিক অক্ষমতাও তৈরি হওয়ার শঙ্কা থাকে। এসব কারণে সুস্থতার বিপরীতে অসুস্থতাই বৃদ্ধি করে। এসব প্রথা সুস্থতার অন্তরায়।