ঢাকার বনানী থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া বরিশালের দুই যুবকের মধ্যে একজন ৪ মাস ১৮ দিন পর তার পরিবারের কাছে ফিরে এসেছে। মেহেদী হাসান নামে ওই যুবক গত মঙ্গলবার বিকেলে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসে। এদিকে নিখোঁজ মেহেদী ৪ মাস ১৮ দিন পর ফিরে আসায় আনন্দে আত্মহারা তার নববিবাহিতা স্ত্রী, বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যরা।
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেহেদীর বাবা জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর হোসেন হাওলাদার বলেন, তার ছেলে যেন আগের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে সে ব্যাপারে সকলের সহযোগীতা চান তিনি। একই সাথে যারা তাকে অপহরণ করে দির্ঘদিন আটকে রেখেছিলো তাদের সনাক্ত করে বিচার দাবি করেন তিনি।
গত পহেলা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মেহেদী হাসান ও একই গ্রামের বন্ধু সুজন ঘরামীসহ ৪জন বনানীর নর্দান ক্যাফে রেস্তোরায় খেয়ে বের হচ্ছিলেন। মেহেদী জানান, রেস্তোরা থেকে বের হয়ে তারা ৪জন হাটছিলেন। একটু অন্ধকার রাস্তায় হঠাৎ কেউ পেছন থেকে তার বাম হাতের বাহু ধরে এবং নাকে একটি রুমাল চেপে ধরে। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন একটি কক্ষে পাকা মেঝে নিজেকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় আবিস্কার করেন তিনি। সেখানে তাকে সময় মতো খেতে দেয়া হতো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী টয়লেটে নেয়া হতো। শুধুমাত্র খাবারের সময় তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হতো। সব সময় তার চোখ বেঁধে রাখা হতো। এ কারণে তিনি কাউকে চিনতে পারেননি। এমনকি কারো কথায়ও কাউকে বুঝতে পারেননি। তবে দির্ঘ সময়ে তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি কিংবা কোন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। কেন এবং কারা তাকে অপহরণ করে আটকে রেখেছিলো তা বলতে পারছেন না তিনি। এমনকি একই সাথে নিখোঁজ সুজন সহ অপর ৩জন কোথায় আছে তাও তিনি বলতে পারেননি। বন্দী থাকাকালীন তাদের কারো সাথে তার কথা কিংবা দেখা হয়নি বলেও দাবি করেছেন মেহেদী।
গত মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকাল ৭টার দিকে সাভারের নবীনগর এলাকায় মহাসড়কের পাশে একটি গাছে হেলানো অবস্থায় নিজেকে আবিস্কার করেন বরিশাল বিএম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী মেহেদী হাসান। নিখোঁজের সময় তার সাথে থাকা ল্যাপটপ, কাপড়-চোপড়-টাকা সবই অক্ষত, অর্থাৎ তার সাথেই ছিলো। এরপর তিনি বাস যোগে গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন। মেহেদীর ফিরে আসার খবর পেয়ে এলাকার মানুষ তার বাড়িতে ভীর করেছে।
মেহেদীকে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী উল্লেখ করে বাবুগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী আক্তারাজ্জামান মিলন জানান, বিগত ইউপি নির্বাচনে মেহেদী স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিপক্ষ এলাকায় আতংক সৃষ্টির জন্য মেহেদীকে অপহরণ করে আটকে রাখতে পারে বলে সন্দেহ তার। মেহেদী কোন জঙ্গিবাদে জড়ায়নি কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও তাকে অপহরণ করে আটকে রাখেনি বলে দাবি ছাত্রলীগ নেতা মিলন কাজীর।
বাবুগঞ্জ থানার ওসি আব্দুস সালাম জানান, মেহেদী নিখোঁজের ঘটনায় বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরী হয়েছিলো। তার বাড়ি ফিরে আসার খবর পেয়ে পুলিশ তার গ্রামের বাড়ি গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মেহেদীর নিখোঁজ হওয়া, আটকে রাখা এবং নবীনগরে আবিস্কারের ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য কিনা জানতে চাইলে বাবুগঞ্জ থানার ওসি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কোন ক্লু উদঘাটন করা যায়নি। তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। তবে মেহেদী শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনগত ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শরীফ শাহাবুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মেহেদী হাসানকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত এবং স্বাভাবিক। তার শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। তারপরও ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষার (রক্ত পরীক্ষা) স্বার্থে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বুধবার দুপুরে তাকে বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বরিশাল জেনারেল (সদর) হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, মেহেদী বলেছে, তাকে একটি কক্ষে চোখ-হাত বেধে আটকে রাখা হয়েছিলো। দির্ঘ সাড়ে ৪ মাস একজন ব্যক্তিকে একটি কক্ষে চোখ-হাত বেঁধে রাখলে তার যেসব শারীরিক সমস্যা হওয়ার কথা কিংবা যেসব উপসর্গ থাকার কথা সেগুলো মেহেদীর মধ্যে নেই। বিষয়টি পুলিশের তদন্তধীন থাকায় এর বেশী কিছু বলতে রাজী হননি ওই চিকিৎসক।
নিখোঁজ হওয়ার ৬ মাস আগে বরিশাল বিএম কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী শারমীন আক্তার রিংকিকে বিয়ে করে সে। একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় গিয়েছিলেন মেহেদী। থাকতেন রায়ের বাজার এলাকায় ফুফুর বাসায়। গত পহেলা ডিসেম্বর বিকেলে বন্ধু একই গ্রামের সুজন ঘরামীর কাছে মেরামত করতে দেয়া একটি ল্যাপটপ আনতে গিয়েছিলেন তিনি। ল্যাপটপ নিয়ে সুজন এবং তার অপর দুই বন্ধু সাফায়াত ও জাইনের সাথে খেতে গিয়েছিলেন বনানীর নর্দান ক্যাফে রেস্তোরায়।
দির্ঘ ৪ মাস ১৮দিন পর মেহেদী বাড়ি ফিরে এলেও একই সময় ও একই স্থান থেকে নিখোঁজ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আলী জাকের ও সারা জাকেরের এ্যাড ফার্মের কর্মচারী সুজন ঘরামী এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাফায়াত হোসেন ও জাইন হোসেন খানের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। এতে উদ্বিগ্ন সুজন, সায়াত ও জাইনের পরিবার।
বিডি প্রতিদিন/১৯ এপ্রিল ২০১৭/হিমেল