হুবেই প্রভিন্সের রাজধানী উহান। বড় সাজানো-গোছানো একটি শহর। শিক্ষা ও বাণিজ্য উভয়ের জন্যই এ শহরের খ্যাতি আছে। চীনের কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার বেশ কিছু প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান আছে উহানে। শুধু খাদ্য উৎপাদন নিয়ে গবেষণাই নয়, কৃষিপণ্য উৎপাদন, বিপণন এবং মূল্য সংযোজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনাতেও ভূমিকা রাখছে চীনের কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনই একটি উদ্যোগ দেখেছি গত মে মাসে। সে সময় চীনের উহান শহরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। উহানে হুবেই ভোকেশনাল কলেজ অব বায়োটেকনোলজি আয়োজন করে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের প্রদর্শনীর। তারা বলছে, এর মাধ্যমে কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে কৃষিশিল্প তথা কৃষিবাণিজ্যের একটি যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন লাভবান হচ্ছে, উন্মুক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান খাত। মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে পণ্যের বাণিজ্যিক প্রসারও নিশ্চিত করা যাচ্ছে।
যাই হোক, প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সরকারে থাকা জনপ্রতিনিধিরা। ব্যতিক্রমী সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হলাম। বিশ্বের জনপ্রিয় পানীয় চায়ের সঙ্গে রয়েছে চীন দেশের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। দেশটিতে চা সংস্কৃতিও খুব বিখ্যাত। শুরুতেই তারা আমাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করল। পরিচয় করিয়ে দিল নানা স্বাদ, গন্ধ আর বাহারি চায়ের সঙ্গে। চীনে সাধারণত গ্রিন টি বা ব্ল্যাক টি বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এবার দেখলাম দুধ চা পরিবেশন করছে। আগ্রহ নিয়ে চুমুক দিয়ে দেখি চায়ের স্বাদ নোনতা। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের অনেক টি স্টলে লাল চায়ে নুন পেয়েছি। কিন্তু দুধ চায়ে লবণ! জানতে চাইলাম, লবণ দেওয়া এ চা কি চীনে জনপ্রিয়? চা পরিবেশনকারী মেয়েটি জানাল, তরুণদের মাঝে এই চা পানের জনপ্রিয়তা বেশি। আমি জানালাম, আমাদের দেশে চিনি দেওয়া ঘন গরুর দুধের চায়ের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। আমাদের গাইড আলবা জানালেন, চীনে সাধারণত ছয় ধরনের চা হয়। গ্রিন টি, হোয়াইট টি, ইয়েলো টি, রেড টি, অলং টি এবং ডার্ক টি। চা ক্যান্সার ও হৃদ রোগের ঝুঁকি কমায়। এক কাপ চা প্রতিদিনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারে। আলবাকে জানালাম, ‘২০০৪, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮ সালে আমি চীনের হাইব্রিড ধানের জনক ইয়াং লং পিংয়ের কাছে এসেছিলাম। তিনি আমাকে চা কীভাবে পান করা উচিত সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন, কীভাবে চায়ের পাত্রটি ধুতে হবে এবং গ্রিন টি তৈরি করতে হবে। আমি তাঁকে আমার চা পানবিষয়ক শিক্ষক মনে করি।’ চীনে ইয়াং লং পিংয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আমার কথা শুনে প্রদর্শনীর আয়োজকদের একজন বললেন, ‘আপনি ইয়াং লং পিং-এর সাক্ষাৎ পেয়েছেন, আপনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবানদের একজন।’ এর আগে এক লেখায় তুলে ধরেছিলাম হুবেই ভোকেশনাল কলেজ অব বায়োটেকনোলজির চা নিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনে যথেষ্ট যত্নশীল।
যাই হোক, প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। যেন একটা সুপার শপ। নানা কৃষিপণ্যের সমাহার। রং-বেরঙের নানান প্যাকেটে সাজানো। এক পাশে মাছের পসরা। না, তাজা মাছ নয়। রেডি টু কুক। মাছের সঙ্গে মসলাপাতি সবকিছু দেওয়া আছে। প্যাকেজ অফার। নানান মাছের নানান আয়োজন। এখানে উচাং নামের এক মাছের কথা বললেন তারা। সে মাছ নিয়ে নাকি আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও জে দং কবিতা লিখেছেন। আলবা জানালেন, হুবেই প্রভিন্স নদী আর হ্রদে ঘেরা, সেসব জলাশয়ের প্রাকৃতিক মাছের সম্ভার, পাশাপাশি চাষের মাছও আছে। সব মিলে মাছ নিয়ে নানান পণ্য, নানান খাবার। প্যাকেটজাত মাছের ডিমও আছে।
চীনে কত রকম আর কত ধরনের ডিম যে আছে তা খোদ চীনের মানুষই জানে না। নানা উপায়ে ডিমের মূল্য সংযোজন করছেন তারা। যার ফল প্রত্যক্ষভাবে পাচ্ছে উৎপাদনকারীরা, নিশ্চিত হচ্ছে দেশের পুষ্টি চাহিদা। ডিমকে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করা। নীল রঙের একটা ডিম দেখে এগিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, সেটা মুরগির ডিম কি না। আয়োজকদের একজন জানালেন, ‘হ্যাঁ মুরগির ডিম। ওটা বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত। লো প্রোটিন স্বাস্থ্যকর একটি ডিম। এতে মূল্য সংযোজন করা হয়েছে।’ প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১০ আরএমবি। অর্থাৎ আমাদের দেশের টাকায় প্রায় ১৬০ টাকা হবে। এই যে দাম বেশি পাচ্ছে এতে উৎপাদক লাভবান হচ্ছেন, লাভবান হচ্ছেন প্রক্রিয়াজাতকারীও। একটা শিল্প তৈরি হয়েছে। শত রকমের মাশরুমের প্রদর্শনী। চীনে মাশরুম খুব জনপ্রিয়। এটিকে তারা খাদ্যের পাশাপাশি ভেষজ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। আমাদের গাইড আলবা বললেন, ‘আমরা প্রচুর পরিমাণ মাশরুম খাই। কেননা আমরা কিন্তু বেশ স্বাস্থ্য সচেতন আর মাশরুম খুব পুষ্টিকর একটি খাদ্য উপাদান। মাশরুমে ডিমের চেয়েও প্রচুর প্রোটিন পাওয়া যায়। এতে আছে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, জিঙ্ক, মিনারেল, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন বি। এ ছাড়াও মাশরুমের আছে ঔষধি গুণ।’ মাশরুমের কর্নার থেকে এগিয়ে গেলাম চালের কর্নারে। বিভিন্ন জাতের চাল। চীন একটি বড় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদক দেশ। চীনের লোকসংখ্যা ১৪০ কোটি এবং সবার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০০ মিলিয়ন টনের বেশি চাল উৎপাদন করে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। কিন্তু জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় চাল আমদানিতেও শীর্ষে আছে চীন। চীন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত থেকে চাল আমদানি করে।
পুরো প্রদর্শনী ঘুরে মুগ্ধ হয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উৎপাদক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দিচ্ছে। বাণিজ্যের বিস্তারে সহায়তা করছে। শিক্ষার্থীরা শিখছে, গবেষণা করছে পাশাপাশি নিজের কাজের ক্ষেত্রটিও প্রসারিত হচ্ছে।
প্রদর্শনী সার্বিক দিক নিয়ে কথা হয় আয়োজকদের একজন শিন বাও-এর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় যে গবেষণা করছে তার ফলাফল বিভিন্ন কোম্পানির কাছে আমরা তুলে ধরছি। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষি শিল্পের প্রসারের চেষ্টা থেকেই আমাদের এ আয়োজন। এটা একটা ত্রিমুখী ব্যবস্থাপনা। গবেষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টা।’
জানতে চেয়েছিলাম, প্রতি বছরই এমন আয়োজন হয় কি না? উত্তরে বললেন, ‘বছরে একাধিকবার একেক ধরনের আয়োজন হয়। একেক ভোক্তার একেক রুচি, চাহিদাও ভিন্ন। ফলে কৃষি শিল্পের বহুমুখী উত্তরণ ঘটছে।’
চীন এক মহাপরিকল্পনা এবং কার্যকরী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো যেমন দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করছে, তৈরি করছে শিক্ষার্থী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নির্ভরযোগ্য সেতুবন্ধ। ফলে বেকারত্ব দূর হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থানের। শিক্ষা ও গবেষণানির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে জ্ঞান ও কর্মের প্রবহমান ধারা তৈরি হয়েছে। যা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনুসরণ করতে পারে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব