প্রযুক্তির দুনিয়ায় নতুন খেলোয়াড় হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। আজকাল সব প্রযুক্তিতে দেখা যাচ্ছে এআইয়ের ব্যবহার। ফোনের ক্যামেরা থেকে শুরু করে কম্পিউটার মাউস সবখানে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে এ নয়া প্রযুক্তি। বাড়ছে এর প্রচার ও প্রসার। এটি দ্বারা নির্মিত চ্যাটজিপিটি কিংবা জেমিনি যেন প্রযুক্তি বিশ্বে করছে রাজত্ব। নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সমাধান করছে জটিল জটিল সমস্যা। এআইয়ের কথা ও কাজ বেশি শোনা যাচ্ছে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। ছবির মধ্যে কারও মুখ চেনা, ম্যাপে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছার রাস্তা দেখানো, টাইপ করার সময় ঠিক কোন শব্দটি খুঁজছি তা বলে দেওয়া, টাইপের পরিবর্তে মুখের কথা শুনেই টাইপ করে দেওয়া, ই-মেইলের সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত উত্তর বানিয়ে দেওয়া- সবই এখন এআইয়ের ক্যারিশমা। তবে প্রযুক্তির এত ব্যাপক উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা এখনো দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি অঞ্চলে অভিজ্ঞ ও নিবেদিত ডাক্তার এবং নার্সের অভাব, অতিরিক্ত রোগীর চাপ, মেডিকেল সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় ইত্যাদি নানা কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে অদক্ষতা এবং সে কারণে ভুল চিকিৎসায় প্রতি বছর দেশে হাজার হাজার রোগী প্রাণ হারান। নেই রোগীর হিস্টোরিক্যাল ডেটা সংরক্ষণের নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফরম, নেই কোনো উন্নত মেডিকেল সফটওয়্যার। এসবের বিকল্প হিসেবে বিশ্ববাজারে এখন রাজত্ব করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি। স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে যেমন এআই গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে তেমনি এআই প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরিতেও খরচ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি এমনই এক এআইভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার টুল বাজারজাত করেছে টেক জায়ান্ট গুগল। সেটি হলো- শব্দ শুনেই বলে দিতে পারবে বিশেষ কোনো রোগে আপনি আক্রান্ত কি না? এর জন্য লাগবে না কোনো মেডিকেল টেস্ট, লাগবে না ল্যাবে দৌড়াদৌড়ি, প্রয়োজন পড়বে না কোনো বাড়তি খরচের। অনেকটা ফ্রিতে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করে দেবে গুগলের এ সিস্টেম। জনমনে তাই প্রশ্ন কতটা নির্ভুলভাবে করতে পারবে রোগ নির্ণয়, এটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে কোন কোন প্রযুক্তি, এর মাধ্যমে কতটা সুফল পাবে সাধারণ মানুষ ইত্যাদি। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে গুগলের বানানো নতুন এআই মডেলটি যে কারও কণ্ঠ শুনে জানিয়ে দেবে তার শরীরে লুকিয়ে থাকা অসুস্থতার কথা, রোগের নাম, ধরন এবং তীব্রতা। গুগল এআই ফাউন্ডেশন নানা ধরনের শব্দ শুনে তৈরি করেছে এ সফটওয়্যার। জানা গেছে ৩০০ মিলিয়ন শব্দ (অডিও সাউন্ড) শোনানো হয়েছে- যেগুলোর মধ্যে রয়েছে হাঁচি, কাশি, হাঁপানি ইত্যাদি শব্দ। শুধু কাশির শব্দই রয়েছে ১০ কোটি, যা কাজে লাগিয়ে এআই ধরে ফেলবে কেউ যক্ষ্মায় আক্রান্ত কি না কিংবা তার হৃদযন্ত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না? এর জন্য সম্প্রতি ভারতের স্টার্টআপ ‘স্যালসিট টেকনোলজিস’ এর সঙ্গেও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে গুগল। সংস্থাটি একটি হেলথ কেয়ার এআই স্টার্টআপ, যা ব্যবহার করে শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে থাকে। মডেলটিকে স্মার্টফোনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে এ স্টার্টআপটি। লক্ষ্য স্মার্টফোনকে এমনভাবে তৈরি করা যাতে ব্যবহারকারীর বিপন্নতাকে অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারে সেটি। তবে গুগলের এ চেষ্টা এটিই প্রথম নয়, আগেও মানুষের চেতনাকে ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করেছে এআই প্রযুক্তি। কিন্তু এবার মানুষের অসুস্থতাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ধরে ফেলার লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে এগোতে চাচ্ছে গুগল, সফলতাও পেয়েছে হাতেনাতে।
শুধু গুগল নয়, এর আগে আমেরিকান সংস্থা ‘মায়ো ক্লিনিক’ও এমন উদ্যোগ নিয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ডায়াবেটিস শনাক্ত করার চেষ্টা করেন তারা, যেখানে কণ্ঠ শুনে মাত্র ১০ সেকেন্ডে যে কোনো ব্যক্তির শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে কি না তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ২০২১ সালে একদল গবেষক ২৬৭ জন ডায়াবেটিস রোগীর ওপর গবেষণাটি করেছিলেন। গবেষণায় স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা একটি নির্দিষ্ট বাক্য সর্বোচ্চ দিনে ছয়বার ব্যবহার করে দুই সপ্তাহ রেকর্ড করেন। মোট ১৮ হাজার ৪৬৪টি রেকর্ডিং ধারণ করা হয় এবং প্রতিটি রেকর্ড থেকে ১৪টি ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বের করে তা বিশ্লেষণ করে এআই মডেলটি। সেই বিশ্লেষণ থেকে স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস আছে কি নাই এমন ব্যক্তিদের আলাদা করতে পেরেছে এবং সঠিক তথ্যটি রোগীকে বলে দিতে পেরেছে নিমেষেই। এ ছাড়া আগাম শনাক্তকরণ বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শ্বাসযন্ত্রের রোগ ছড়িয়ে পড়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এই এআই টুলটি। পাশাপাশি যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য নয় সেখানেও একেবারে শুরুতেই রোগের লক্ষণ শনাক্ত করার মাধ্যমে রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে এ টুলটি।
এমনিভাবে গুগলের হেলথ অ্যাকোস্টিক রিপ্রেজেন্টেশন (HeAR) মডেল একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যা শরীরে উৎপন্ন শব্দ থেকে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ নির্ণয় করতে সক্ষম। এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দূরবর্তী বা গ্রামাঞ্চলে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সহজে রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৫০০ মানুষ যক্ষ্মায় মারা যাচ্ছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এ রোগ শনাক্তকরণে শব্দকে ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ যক্ষ্মার কারণে মারা যায়। আবার বায়ো অ্যাকোস্টিক এমন একটি শাখা যেখানে জীববিজ্ঞান এবং শব্দবিদ্যা মিলিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষ এবং প্রাণীর উৎপাদিত শব্দগুলো বিশ্লেষণ করে তাদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করা। উদাহরণস্বরূপ, শ্বাস, কাশি এবং স্নিফলসের মতো সাধারণ শারীরিক শব্দগুলোতে এমন সূক্ষ্ম সংকেত থাকে যা বিভিন্ন রোগ শনাক্ত করতে সহায়ক। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে গুগলের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ডিভিশন ‘জিবি’ থেকেও এমনই একটি প্রজেক্টে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যেখানে এআই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের অনুভূতিকে ডিজিটাইজ করার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়