বন্দোবস্ত বলতে প্রথা, প্রচলন, কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি এ জাতীয় সব ইতিবাচক ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনঘনিষ্ট পরস্পরের সহায়ক, লেনদেন কার্যকারিতার অনুশীলন। এই অনুশীলনের নেতিবাচকতা হ্রাস করে ইতিবাচকতা বৃদ্ধির দ্বারা সাম্য, গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিসহ বাস্তবায়ন টেকসই করতে আইনকানুন, নীতিমালা-বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। যাতে নাগরিকদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাদাচোখে নাগরিক কোনো সার্বভৌম অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের কল্যাণে তাদের মতামতে দেশ শাসন করার বাধ্যবাধকতা থাকলে সে দেশের স্বীয় বাসিন্দাদেরই নাগরিক বলা হয়। অর্থাৎ নাগরিকরাই স্বীয় দেশের মালিক। এই মালিকরা তাদের দেশ পরিচালনার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকদের কল্যাণে সুবিধা দেওয়া, সেবার দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। রাষ্ট্র থেকে দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিরা সেবা দেওয়ার তহবিল বাবদ সামর্থ্যবান নাগরিকের কাছ থেকে খাজনা, ট্যাক্স, ভ্যাট, শুল্ক ইত্যাদি দিয়ে রাষ্ট্রের তহবিল জোগান দেন। রাষ্ট্রের তহবিল দ্বারা নাগরিকদের প্রতিশ্রুত সেবা দিতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। ‘It is an unwritten gentlemen agreement in between political person and civil person’ অর্থাৎ ‘জনগণ এবং নাগরিকের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদদের অলিখিত চুক্তি।’ এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তি ভঙ্গকারী সব ধর্ম, পৌরাণিক, সামাজিকভাবে ঘৃণিত এবং পাপিষ্ঠ ব্যক্তি। তাই রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি হওয়া অত্যন্ত কঠিন। আমাদের মতো এনজিওরা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের সাহস করে না, এজন্যই প্রায় সব এনজিওর গঠনতন্ত্রে রাজনীতি না করার আইন সন্নিবেশিত আছে। ফলে এনজিওদের তাদের কর্ম-এরিয়াতে আয়েশচিত্তে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকে। এনজিওতে সরকারি বরাদ্দ না থাকলে নাগরিকদের দেওয়া খাজনা, ট্যাক্স, ভ্যাটের মাধ্যমে যে তহবিল সরবরাহ করা হয়, তার হিস্সা আসে না। ফলে অর্থনৈতিকভাবেও নাগরিকদের প্রতি এনজিওদের দায়বদ্ধতার চুক্তি জিওর মতো নয়। এজন্যই আমার অনুমান বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সুশীলরা গালি দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘এনজিও মার্কা সরকার’ বলে থাকেন।
জিও, জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং এনজিও অর্থাৎ স্বেচ্ছায় সমাজসেবক ব্যক্তিদের মধ্যে মৌলিক তফাত জিও ব্যক্তির কাছ থেকে দেশের মালিক জনগণের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং তাদের প্রত্যাশা প্রতিপালন করার বাধ্যবাধকতা আছে। এনজিও ব্যক্তির কাছে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ বাধ্যবাধকতা নাই, ঐচ্ছিকভাবে অতি ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সেবা দেওয়ার রেওয়াজ, প্রথা বিদ্যমান আছে। তাই এনজিওদের কাজকে আয়েশি কাজ বলা যায়। জিওদের দায়িত্ব পালন আয়েশি নয়- আবশ্যিক, ঝুঁকিযুক্ত গুণসম্পন্নভাবে করতে হয়। অপরদিকে জিওদের কার্যক্রম ব্যয় বাজেটের জন্য ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ নেই। এনজিওদের কার্যক্রমের ব্যয় বাজেট সংগ্রহের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। তাই জিও-এনজিওকে একাকার করে দেখার সুযোগ নাই।
১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে অভ্যুত্থান, বিপ্লব হয়ে আসছে। অভ্যুত্থান, বিপ্লবের প্রাথমিক কাজ সংগ্রাম। ওই সময়কালের ইংরেজদের বিরুদ্ধে সব সংগ্রামে মুসলিম ছাত্র-জনতা অগ্রসারিতে ছিল। বেশুমার আত্মাহুতি দিয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রসমাজের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নাই। মুসলিমদের আন্দোলনের বাড়াবাড়িতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি/বিলেতি এনজিও, পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার এবং সর্বশেষ গভর্নর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মুসলমানদের প্রতি রুষ্ট, ক্ষিপ্ত অবস্থায় নগণ্য, অগুরুত্বপূর্ণ যা দেওয়ার তাই দিয়ে এমনভাবে বর্ডার বিভক্তি করেছিলেন, যাতে ভারত এবং পাকিস্তানের আন্তবর্ডার বিবাদই শুধু নয়, অঞ্চলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যাওয়ার স্বনির্ভর উপাদান আজও বিদ্যমান। ১৯৪৭ সালের পর ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলনে সামনের সারির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম-অভ্যুত্থান-বিপ্লব ইত্যাদিতে লেগে থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশকে স্বাধীন করলেন, তা যেমন ঠিক তেমনি অনেক অঠিক- যা ছিল নাগরিকদের প্রতি জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি/অঙ্গীকার ভঙ্গকরণ, রাজনীতিকে ব্যবসা গণ্যকরণ। যার ফলে তাকে বলতে হয়েছিল ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষ আট কোটি কম্বল, আমার কম্বল কোথায়।’ ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’ এরকম বাস্তবসুন্দর বাক্যগুলো শুধু রেটরিক হিসেবে আছে।
রাজনীতিবিদরা তাদের প্রতিশ্রুত নাগরিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে রাজনীতিকে রাজার নীতি গণ্য করে নিজেরা রাজাধিরাজ হতে চাইলেন বা হলেন। ফলে বিলাস জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যবহুলতা ভোগ করার জন্য বিশ্বের স্ব^র্গতুল্য সিটিতে বাড়িঘর, ব্যবসা, ভোগবিলাসের আধিক্য করলেন। ছোটখাটো রাজনীতিবিদ-আমলা নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করবেন, রাজকীয় ব্যবসাবাণিজ্য করবেন, চূড়ান্ত বিলাস ভোগ করবেন। তাই যুদ্ধ প্রশিক্ষণ বিমানের প্রশিক্ষক, তার পরিবার, প্রশিক্ষণার্থী, যাবতীয় জায়জোগাড় বিশ্বের সর্বাধিক জনঘনত্ব মহানগরী ঢাকাতেই করতে হবে, রাখতে হবে! মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকের আত্মাহুতির বিলাপ তাদের নিকট বিলাস। সব অভ্যুত্থান এবং বিপ্লবের শক্তিধর জ্বালানি উপাদান হচ্ছে বৈষম্য। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি ও সম্পদ বৈষম্যজনিত কারণে সব অভ্যুত্থানে উত্তরবঙ্গের ছাত্র-জনতা নীরব, নিরীহ সৈনিকের কাজ করেন। কারণ বেকারত্বের মধ্যে তারা জর্জরিত। ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, ঈশ্বরদীর পরিত্যক্ত বিমানবন্দরকে প্রশিক্ষণ বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুললে প্রশিক্ষণ ক্লাসের ছাত্র-শিক্ষকদের বাড়িতে ঝি হিসেবে, আয়া-পিয়ন হিসেবে, বাজার-ব্যাগবাহী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেত, তাহলে বেকারদের ক্ষিপ্ততা কমত। নব্বইয়ের অভ্যুত্থান, চব্বিশের ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান এগুলোর মৌলিক চেতনা ছিল বন্দোবস্তের পরিবর্তন। যে পরিবর্তন দেখে আমাদের মতো দুর্বল মানুষ জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রস্তাবে হাউমাউ করে কেঁদে উঠত, ভয়ে জড়সড় হতো। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ বর্তমান অরাজনৈতিক সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার এদিকে আসার ইচ্ছা আছে কি?’ উত্তরে বলেছি, ‘কোনোই সুযোগ নাই, স্যার। আপনার সহায়তাপুষ্ট টিএমএসএসের একটি পর্যায় না আসা পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মতো নাগরিক দায়বদ্ধ কোনো দায়িত্ব পালনের সাহস, শক্তি, প্রজ্ঞা, সামর্থ্য কিছুই আমার নাই। আমাকে মুক্ত রেখে টিএমএসএসের অধিকার, হক, প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলে আমরা তৃণমূলের উন্নয়নে যা করছি তা সরকারের সম্পূরক-পরিপূরক ভূমিকা পালন হচ্ছে। ফলে সরকারের স্থায়িত্ব, রাষ্ট্রের উৎপাদন, উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।’
প্রিয় পাঠক, জনপ্রতিনিধি-রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যদি দেশ তথা সামষ্টিক উন্নয়নে আনন্দ না পান ব্যক্তি উন্নয়ন, পারিবারিক উন্নয়ন এবং নিজস্ব বলয়ের উন্নয়ন তাদের আনন্দের ইস্যু হয়- সে ক্ষেত্রে বন্দোবস্তের পরিবর্তন না করে ব্যক্তির পরিবর্তন দ্বারা কখনোই কাক্সিক্ষত উন্নয়ন আসবে না। অর্জন উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে খালেস নিয়তে উন্নয়নের কাজ, পুণ্যের কাজ যা-ই করা হোক না কেন ফল দেবে না, কাজে আসবে না। প্রায় প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলায় সুরম্য মডেল মসজিদ স্থাপনের পরও মসজিদের খতিবকে পালিয়ে যেতে হয়। অধীনস্থ প্রশিক্ষিত সশস্ত্র সর্ববাহিনী, নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী এবং নিরীহ প্রায় দুই কোটি নাগরিক পক্ষে থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মণ সেনের মতো পলায়নপর হতে হতো না। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ- যাদের রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, তাদেরও ফকির বিদ্রোহ, বাঁশের কেল্লা ব্যবহারকারী নিরস্ত্র জনতার কাছে দেশ ছেড়ে দিতে হয়েছে। সততা শক্তি, অন্যায়-অনাচার একরকম ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
তৃণমূল গণমানুষের কল্যাণে ব্যাপক কাজের জন্যই শক্তিধর ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে যেতে হয়। তাই যারা দায়িত্বের স্টিয়ারিং ধরে থাকেন তাদের কাছে টিএমএসএসকে যেতেই হয়। যেহেতু টিএমএসএস প্রায় বিদেশি অনুদানহীন সংস্থা, সংস্থার আজীবন সদস্য যারা, মূলত মালিক তারাও অনুদান দিয়ে সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় বহন করতে পারেন না। তাই ব্যবসাবাণিজ্য, কোম্পানি, শিল্প-কারখানা দ্বারা দাতার বিকল্প হিসেবে নীতিসহায়তা নেওয়ার জন্য সব সরকারের কাছে ধরনা দিতে হয়, ভবিষ্যতেও এভাবেই করে যেতে হবে।
সরকারি অনুশাসন মেনে স্বাধীন অঞ্চলের মধ্যে জনগণের সম্পৃক্ততায়, সহায়তায় পরিচালিত ক্ষুদ্র টিএমএসএসের ব্যবস্থাপনা অনুশাসন করতে গিয়ে কতই না ভুল হচ্ছে। ভুলের পরিকল্পনার সময় বা ভুল হওয়ার সময় ভুল ধরার ব্যক্তি, এখতিয়ারাধীন বেতনভুক্ত ব্যক্তি অপেক্ষা উপদেষ্টা, পরামর্শক, আজীবন সদস্য তাদের ওপরে যথেষ্ট প্রত্যাশা থাকলেও এ পর্যন্ত টিএমএসএসের উপদেষ্টা, পরামর্শক দ্বারা ভুল সংঘটিত হওয়ার আগে বা ভুল চলাকালীন ভুল ধরে দেওয়ার অর্জন নাই বললেই চলে। অনুমিত হয় কর্তাব্যক্তির ভুল সংশ্লিষ্ট মতলববাজিদের কাছে সহায়ক। তাই উন্মুক্ত অংশীদারিমূলক ব্যবস্থাপনা এবং সবার সক্রিয় অনুসন্ধান দ্বারা টিএমএসএসের বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের উপার্জনের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্যতা অনুসন্ধানের কাজ এগোচ্ছে না। তাই জিওতেই শুধু না এনজিওতেও ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, নিয়মনীতির পরিবর্তন, আমূল ও বন্দোবস্তের পরিবর্তন দরকার। নচেত বঞ্চিত ব্যক্তিদের দ্বারা বিপ্লব হতে বাধ্য। সাধু সাবধান।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস
ইমেইল : [email protected]