শিরোনাম
বুধবার, ১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

দাপটের শেষ নেই সিবিএ’র

অফিস করতে হয় না কোনো নেতার

আলী রিয়াজ

বছরের পর বছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সিবিএ নেতারা একই পদে বসে আছেন। একই পদে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছেন, কিন্তু পদোন্নতি নিচ্ছেন না। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ ও দলীয় কার্যক্রম ছাড়া এখন তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। ব্যাংকের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনো আন্দোলনও হচ্ছে না কয়েক বছর ধরে। সবগুলো ব্যাংকই এখন সরকারদলীয় প্রভাবিত শ্রমিক লীগের সমর্থিত সিবিএ কমিটি দিয়ে চলছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত কমিটিও নেই। প্রতিদিন অফিসে এসে সিবিএ কার্যালয়ে সারা দিন আড্ডা দিয়ে চলে যান নেতারা। ব্যাংকের কাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই।

জানা গেছে, ব্যাংকের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ থাকায় সিবিএ সংগঠনগুলোতে নতুন নেতৃত্ব আসছে না। আশির দশক থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন এখনো সেই ব্যক্তিরাই সিবিএ ধরে রেখেছেন। অনেকে অবসরে যাওয়ায় কিছু সংগঠন নাই হয়ে গেছে। সব ব্যাংকের সিবিএ নেতারা বিভিন্ন বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন। ব্যাংকের অফিসাররা ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত গাড়ি কিনতে টাকা নিতে পারেন। কিন্তু একজন কর্মচারী মোটরসাইকেল কিনতেই ৩ লাখ টাকা নিলে ৫ শতাংশ সুদ দিতে হয়। কর্মচারীদের ক্ষেত্রে অন্য বৈষম্যও রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ পাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা গড়ে তুলছেন নতুন সংগঠন। স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অফিসারদের সমন্বয়ে এই সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকারের ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক জোট হচ্ছে। ব্যাংক খাতে পরিচিতি পাচ্ছে ডিজিটাল সিবিএ নামে। বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকে কোনো সিবিএ কার্যক্রম নেই। অন্যগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে আওয়ামী লীগ সমর্থিক দুটি সংগঠন কার্যক্রম চালাচ্ছে। জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংগঠন সক্রিয় আছে। তবে সবগুলো ব্যাংকের সিবিএ কার্যক্রমের নেতৃত্বে আছে আওয়ামী সমর্থিত প্যানেল।

সোনালী ব্যাংক : রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বড় এই প্রতিষ্ঠানটিতে আওয়ামী সমর্থিত সিবিএ এখন নেতৃত্বে। ২০০৮ সালের পর থেকে কোনো নির্বাচন ছাড়াই চলছে সংগঠন। মূল সিবিএ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন কামাল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান খসরু। তারা দুজনেই গোডাউন চৌকিদার হিসেবে চাকরি শুরু করে এখন টাইপিস্ট পদমর্যাদায় চাকরি করছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে। তাদের সমসাময়িক কর্মচারীরা এখন অনেকেই এজিএম হয়ে গেছেন। কিন্তু তারা কোনো পদোন্নতি নেননি। বিএনপি সমর্থিত কোনো গ্রুপ না থাকায় আওয়ামীপন্থিরা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অন্য দুটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ জামাল উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিন। আরেকটি গ্রুপের নেতারা অবসরে যাওয়ায় এখন দুই গ্রুপ সক্রিয় আছে। এই গ্রুপের নেতারাও কোনো পদোন্নতি না নিয়ে চাকরি করছেন বছরের পর বছর ধরে। নেতারা প্রতিদিন ব্যাংকে আসেন। খাতায় হাজিরা দিয়ে সিবিএ অফিসেই সারা দিন আড্ডা দেন। ব্যাংকের কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। সিবিএ কার্যক্রম নিয়ে একটি গ্রুপের সভাপতি জামাল উদ্দিন বলেন, দলীয় সংগঠন আছে, তাতে অংশ গ্রহণ নেই। তিনি স্বীকার করেন, ব্যক্তিগত তদবির ছাড়া সিবিএর তেমন প্রভাব নেই। অধিকন্তু অনেক নেতাই কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, দুর্নীতি করেন। এতে সিবিএর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। অনেক নেতার ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে বলে তিনি জানান।

জনতা ব্যাংক : ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত গ্রুপটি বর্তমান সিবিএ দায়িত্বে আছে। এই কমিটির সভাপতি হচ্ছেন রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান। ২০০৭ সালে সিবিএ নির্বাচনে সভাপতি হন সিরাজুল ইসলাম। তিনি এখন জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। অবসরে যাওয়ার পরও তিনি বর্তমান সিবিএ কমিটির উপদেষ্টা। ব্যাংকের সব ধরনের ক্ষমতার অধিকারী এখনো তিনি। ২০০৭ সালের পর থেকে নির্বাচন না হলেও একচেটিয়া কমিটি গঠন করে সিবিএ দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে বিএনপি সমর্থিত গ্রুপও সক্রিয়। বিএনপি সমর্থিত অংশের সভাপতি মো. ইয়াসিন ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। পাশাপাশি অফিসে সারা দিন একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান দুই গ্রুপের নেতারা। দুই গ্রুপের নেতারাই ইউডিএ পদমর্যাদায় ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে চাকরি করছেন। কখনো কেউ পদোন্নতি না নিয়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ব্যাংকের ঋণ, চাকরি, বদলির তদবির করেন। সকালে অফিসে এসে খাতায় হাজিরা দিয়ে সিবিএ অফিসে আড্ডা দেন।

অগ্রণী ব্যাংক : এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনে অংশ নেয় শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল। ফলে এখন সিবিএর দায়িত্বে আছেন তারা। বর্তমান সিবিএ সভাপতি খন্দকার নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. জয়নাল আবেদিন। সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা বিকম অনার্সসহ মাস্টার্স। কিন্তু তিনিও ইউডিএ পদমর্যাদায় চাকরি করছেন বছরের পর বছর। তার সমসাময়িক অনেকেই এখন ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। বিএনপিপন্থি প্যানেলের বর্তমান সভাপতি খোকা মিয়া, সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন। একইভাবে তারাও প্রতিদিন অফিসে আসেন। নিজেদের সংগঠনের কার্যালয়ে সারা দিন সময় কাটান। ব্যাংকের কোনো কার্যক্রমে তাদেরও অংশ নিতে হয় না। সিবিএ নিয়ে বর্তমান সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপিপন্থি প্যানেল নেতাদের আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু তারা নির্বাচনে আসেনি। ফলে একদলীয়ভাবে আমরাই নির্বাচিত হয়েছি। তিনি বলেন, সিবিএ সম্পর্কিত যে অভিযোগ সেটা থেকে আমরা মুক্ত।

রূপালী ব্যাংক : আওয়ামীপন্থি প্যানেল দায়িত্বে রয়েছে ব্যাংকটিতে। গত বছর চার প্যানেলের অংশগ্রহণে নির্বাচনে তারাই জয়ী হয়। আওয়ামীপন্থি হিসেবেই তিন গ্রুপ অংশ নেয় ওই নির্বাচনে। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেল একচেটিয়া ভোট পায়। বিএনপিপন্থি প্যানেল অংশ নিলেও তারা তেমন কোনো ভোট পায়নি। বর্তমান সভাপতি মোস্তাক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক কাবিল হোসেন। বিএনপি প্যানেলের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের। দুই গ্রুপের নেতারাই সারা দিন সিবিএ অফিসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। নেতারা অনেকেই ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় চাকরি করছেন। এই ব্যাংকে সিবিএ নেতাদের প্রভাব তুলনামূলক কম।

অফিসারদের ডিজিটাল সিবিএ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অফিসারদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ। গত ৮ বছরে ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতারাই এই সংগঠন গড়ে তুলছেন। ব্যাংকপাড়ায় এই সংগঠন ডিজিটাল সিবিএ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ইতিমধ্যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক হামিদুল আলম সখা ও সদস্য সচিব সাব্বির আহমেদ শিমুল। গত ২৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে তারা। ডিজিটাল সিবিএ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নতুন এই সংগঠন নিয়ে অনেক কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সদস্য সচিব সাব্বির আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন, দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংক ও অফিসারদের কল্যাণে আন্দোলন সংগ্রামের জন্য এই সংগঠন গঠিত হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর