রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিহত জঙ্গি কমান্ডারের নাম জাহিদুল, শরীরে ৯ গুলি

বিশেষ প্রতিনিধি

নিহত জঙ্গি কমান্ডারের নাম জাহিদুল, শরীরে ৯ গুলি

রাজধানীর মিরপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রশিক্ষকের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তার আসল নাম মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। তিনি পরিচয় গোপন করে নিজেকে মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর নামে পরিচয় দিয়ে জঙ্গিদের জন্য বাসা ভাড়া নিতেন। আইএসপিআর পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান জানান, মেজর মুরাদ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি এবং সেনাবাহিনী থেকে এই নামে কেউ অবসরেও যাননি। তবে সেনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি করতে করতে রূপনগরের বাসা (ছাড়া নীড়) থেকে পালাতে চেয়েছিলেন জাহিদুল। কিন্তু ছয়তলা থেকে নিচে আসার পরপরই তার পিস্তলের গুলি ফুরিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে ঝাপটে ধরতে গেলেই কোমরে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তিনি এলোপাতাড়ি হামলা চালান পুলিশের ওপর। এতে আহত হন রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিদর্শকসহ (তদন্ত) চার কর্মকর্তা। আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায় পুলিশ। এতে মাটিতে লুটে পড়েন জাহিদুল। গত ১ জুলাই রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী পরিচয়ে ভাড়া নেন তিনি। দুই দিন থাকার পর পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান। এর মধ্যে দু-এক দিন পরপর জাহিদুল একা বাসায় আসতেন। গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার দেওয়ান বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর পুলিশ ওই বাড়িসহ এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। এরপর থেকেই বাসিন্দাদের সন্দেহের মধ্যে পড়ে যান জাহিদুল। গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই বাড়ির মালিক, বাসিন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, বাড়ির মালিক ও আশপাশের লোকজনকে পুলিশ জাহিদুলের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য অনুরোধ করে। গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাহিদুল বাসায় এলে লোকজন বিষয়টি থানায় জানান। পুলিশ তাদের বাইরে থেকে দরজা আটকে দিতে বলেন। পুলিশের নির্দেশ মতো কৌশলে বাসার সামনের দরজা আটকে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে টের পেয়ে যান জাহিদুল। তিনি বাড়ির মালিকের ছেলেকে ফোন করে দরজা খুলে দিতে হুমকি দেন। নইলে গুলি চালাবেন বলে জানান জাহিদুল। রাত ৮টার দিকে পুলিশ ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। রোডের মাথায় মূল গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাড়িটির চারদিক ঘিরে ফেলে পুলিশ। এরপর থানার ওসি ও পরিদর্শক তদন্তসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ ওই বাড়িতে ঢুকে জাহিদুলকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন জাহিদুল জানিয়ে দেন, তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। এ সময় জাহিদুল ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ বলে স্লোগান দেন। পরে অভিযানকারী দল কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ও কয়েক রাউন্ড ফাঁকাগুলি ছোড়ে। তখন জাহিদুলও পুলিশকে গুলি ছোড়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে পুলিশ দরজা খুলে নিচের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে অবস্থান নেয়। এর পরপরই গুলি করতে করতে নিচে নেমে আসেন জাহিদুল। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে একপর্যায়ে তার গুলি ফুরিয়ে যায়। তখন পুলিশ তাকে ঝাপটে ধরতে গেলে কোমরে রাখা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এতে আহত হন থানার দুই ওসিসহ চার পুলিশ কর্মকর্তা।

পরিচয় মিলল মিরপুরে নিহত জঙ্গির : নিহত জঙ্গির পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। তার আসল নাম মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা সদরের পাঁচথুবি চাঁদপুর মৌজায়। তার বাবার নাম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম। মায়ের নাম জেবুন্নাহার ইসলাম। জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় দেওয়া আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত নাম আড়াল করে জাহাঙ্গীর ছদ্মনামে তিনি মানুষের কাছে পরিচিত হতেন। নব্য জেএমবির প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করতেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর পরিচয়ে তিনি জেএমবি সদস্যদের জন্য বাসা ভাড়া করে দিতেন। মিরপুরের রূপনগরের ওই বাসাটিও তিনি জাহাঙ্গীর নামে ভাড়া নেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় যে জঙ্গি আস্তানায় গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম নিহত হন, ওই বাসাটি ছাড়াও কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাটিও জাহাঙ্গীর নামে ভাড়া নিয়েছিলেন এই জাহিদুল। গত শুক্রবার রাতে রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত হন জাহিদুল ইসলাম। প্রথমে তার পরিচয় নিশ্চিত না হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে তার নাম মুরাদ বলে জানানো হয়। গতকাল তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভাণ্ডারে সংরক্ষিত আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে দেখা হয়। রাতে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এনআইডির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম নামের এই ব্যক্তির জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। তার পেশা হিসেবে সরকারি চাকরি লেখা রয়েছে। ভোটার নম্বর ২৬০৯৬২০০০০৭২। তার জন্ম রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০২০০৭১৯৫০০৬০৩৬১৫৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। থুঁতনির নিচে কাটা দাগ রয়েছে। রক্তের গ্রুপ এ-পজেটিভ। ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর সিপি ০১৬৫৬৯৩ এইচএস। পাসপোর্ট নম্বর ওএ ৬০১২৫৬৬। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভাণ্ডারে তার বর্তমান ঠিকানা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত পল্লবী থানাধীন মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। যার ওয়ার্ড নম্বর ৬। ৪২৩/৯ অফিসার্স কোয়ার্টার।

ময়নাতদন্ত সম্পন্ন : জাহিদুলের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। শরীরে ৯টি গুলি বিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। গতকাল দুপুরে লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। বেলা পৌনে ৩টার দিকে মর্গ থেকে বেরিয়ে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, গুলিতেই জঙ্গি জাহিদের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় তিনটি, বুক এবং শরীরের অন্যান্য অংশ মিলে মোট ৯টি গুলি লাগার চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিগুলো শরীরের এক পাশে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তিনি জানান, ময়নাতদন্তে কাউন্টার টেররিজম এবং এফবিআইয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ভিসেরার রিপোর্ট তৈরির জন্য মুরাদের রক্ত, চুল, থাই মাসল ও ইউরিন সংগ্রহ করা হয়েছে।

অস্ত্রোপচার শেষে আইসিইউতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা : অভিযানের সময় জঙ্গি হামলায় আহত তিন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে দুজনকে অস্ত্রোপচার শেষে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। শুক্রবার রাতেই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তাদের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। আহত ওসি সৈয়দ সহিদ আলম ও পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকিরের দেহে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। অস্ত্রোপচারের পর তারা শঙ্কামুক্ত হয়েছেন বলেও গতকাল দুপুরে জানিয়েছেন ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান।

শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুরের রূপনগরের ৩৩ নম্বর সড়কের একটি বাসায় পুলিশের অভিযানে জেএমবি সদস্য জাহিদুল নিহত হন। অভিযানে আহত রূপনগর থানার দুই কর্মকর্তা শহীদ ও শাহীনকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শহীদের কোমরে এবং শাহীনের বাঁ কাঁধ ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের জখম রয়েছে। শাহীনের ডান পায়েও জখম রয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, স্কয়ার হাসপাতালে ভোর ৪টার দিকে তাদের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হওয়ার পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তারা এখন আশঙ্কামুক্ত। অভিযানে আহত পুলিশের আরও তিন সদস্য ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন, তারাও এখন শঙ্কামুক্ত।

সর্বশেষ খবর