সোমবার, ৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

৯ হাজার মৃত মামলায় নতুন মোড়

একে একে বেরিয়ে আসে নেপথ্য রহস্য, শেষ পর্যায়ে আরও চার হাজার

আনিস রহমান

ঘটনা-১ : সিলেটের বালাগঞ্জ থানার জামালপুরের (খাইশাপাড়া) বাসিন্দা মনির আলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। তিনি চিকিৎসা খরচ জোগাতে তার বসতভিটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি সেই জমি আর বিক্রি করতে পারেননি। আগেই তার আকস্মিক মৃত্যু হয়। মনিরের এই হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ ছিল তার স্ত্রী ফাতেমা বেগমের। ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। বালাগঞ্জ থানা পুলিশ দীর্ঘ এক বছর ধরে তদন্ত করেও খুনের বিষয়টি জানতে পারেনি। আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে মামলার তদন্ত শেষ করে পুলিশ। কিন্তু কিছুদিন পর তদন্তের ভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিবিআই। পিবিআই মামলার পুনঃ তদন্ত করলে ঘটনা নতুন মোড় নেয়। পিবিআই নিশ্চিত হয়, এটি নিছক কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

ঘটনা-২ : ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানার আঠারোবাড়ী রেলস্টেশনের সিগন্যালের কাছের ঘটনা। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর রেললাইনের ওপর থেকে খায়রুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তির ট্রেনে কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। খায়রুল ইসলামের স্ত্রীর আবেদনের ভিত্তিতে প্রথমে থানা ও পরে সিআইডি তদন্ত করে। কিন্তু তারা আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে মামলার তদন্ত শেষ করে। পরে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলা পিবিআইকে পুনঃ তদন্ত করার নির্দেশ দেয় আদালত। মাত্র তিন মাসের তদন্তে এ মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসে। নতুন মোড় নেয় তদন্তে। পিবিআই জানতে পারে, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ খুনের ঘটনায় জড়িত আসামিদেরও গ্রেফতার করা হয়। তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। শুধু এই দুটি ক্লু-হীন খুনের ঘটনাই নয়, খুনসহ এমন বহু ক্লু-হীন মামলা পুনঃ তদন্তে পেয়েছে নতুন মোড়। পিবিআই জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও জমা দিয়েছে, যা বিচারাধীন। অনেক মামলায় আবার আসামিদের সাজাও দিয়েছে আদালত। পিবিআই সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (আইন ও গণমাধ্যম শাখা) মো. আসাদুজ্জামান জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সিআর এবং জিআর প্রায় ১৩ হাজার মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর মধ্যে ৯ হাজার ২৬৭টি মামলা তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। যেসব হত্যা মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে এর অধিকাংশই ছিল ক্লু-হীন। সূত্র জানায়, পিবিআই প্রতিষ্ঠার প্রায় ২৬ মাস পর গত বছরের ৫ জানুয়ারি পুলিশের তদন্তকাজে বিশেষজ্ঞ এই ইউনিটের বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর আগে পিবিআই যাত্রা শুরু করেছিল ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর। কিন্তু নতুন একটি ইউনিটের বিশেষ ধরনের কাজগুলো আটকে ছিল এই বিধিমালার অভাবে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিধিমালা হলেও গুরুত্বপূর্ণ বা চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো এখনো তদন্ত করতে পারছে না পিবিআই। এখন পিবিআই যে মামলাগুলো তদন্ত করছে এর প্রায় সবগুলোই এসেছে আদালতের নির্দেশে। দু-একটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে। পিবিআই সূত্র জানায়, সিলেট জেলা পিবিআইর দীর্ঘ এক বছর তদন্তে বেরিয়ে আসে ক্যান্সার আক্রান্ত মনির আলীর মৃত্যুরহস্য। মনির আলী আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। থানা পুলিশও মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ক্যান্সার আক্রান্ত মনির আলীর দুই হাতই অকার্যকর ছিল। এমন অবস্থায় তার আত্মহত্যা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পরে সাক্ষ্য-প্রমাণে জানা যায়, মনির তার বসতভিটা সৎ মা আরফুল বিবি ও তার নিজের নামে দলিল করেছিলেন। চিকিৎসা খরচ নির্বাহের জন্য মনির এ জমি বিক্রি করতে চাইলে আরফুল বিবি ও তার ছেলে-মেয়েরা অপত্তি জানান। একপর্যায়ে তারা পরস্পর যোগসাজশে বিষ কিনে এনে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ান মনিরকে। পরে বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়। এই ক্লু-হীন মামলায় পিয়ারা বেগম (৩৫), আমিরজান (৩৬), সুরজান বেগম (৩৮) ও আরফুল বিবিকে আসামি করে গত বছর ৯ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পিবিআই। ময়মনসিংহে রেলে কাটা খায়রুল ইসলামের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। খায়রুলের স্ত্রী শিরিন আক্তার পুলিশের কাছে খুনের অভিযোগ করলেও পুলিশ ও সিআইডি কোনো সংস্থাই তা বের করতে পারেনি। পরে ময়মনসিংহ জেলা পিবিআই তদন্ত শুরু করে। পিবিআই মামলাটি তদন্তকালে সন্দিগ্ধ হিসেবে মো. মিলন (৩০) নামে একজনকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মিলন নিজেকে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে হত্যার উদ্দেশ্য, হত্যার পরিকল্পনা এবং হত্যা করে রেললাইনের ওপর ফেলে রাখার বিষয়টি তার সহযোগী আসামিদের নাম উল্লেখসহ স্বীকারোক্তি দেন। ১১ জানুয়ারি একইভাবে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মিলন। অথচ এটিও ছিল একটি ক্লু-হীন হত্যা মামলা। পিবিআইর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সিলেট কোতোয়ালি থানায় দায়ের হওয়া বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সরকারি দলিলপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে ৪২২ একর তারাপুর চা-বাগান (দেবোত্তর সম্পত্তি) আত্মসাতের দুটি মামলা তদন্তকালে চরম প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও কোনো তদন্তকারী সংস্থাই নিষ্পত্তি করতে পারেনি। সিলেট পিবিআই এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে সঠিক ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করে চার্জশিট জমা দেয়। চার্জশিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাগীব আলী ও তার পরিজনের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তখন রাগীব আলী ও তার পরিজন ভারতে পালিয়ে যায়। বর্তমানে তারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দী। ময়মনসিংহের নান্দাইলে ২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট শ্যামল দাস (২৮) নামে স্থানীয় এক যুবক নিখোঁজ হন। পরদিন এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। তিন দিন পর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শ্যামলের মৃতদেহ পাওয়া যায় বুধাইবুড়ী বিলে। পরে এ ঘটনায় শ্যামলের বড় ভাই দিলীপ দাস বাদী হয়ে নান্দাইল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। একই বছরের ২২ আগস্ট মামলাটি হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত থানা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডির মোট আটজন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেন। থানা পুলিশ ও ডিবি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হলে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মো. আবদুস ছালাম ওরফে সম্রাট (৩০) নামে একজনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি চার্জশিট জমা দেয়। বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে পরে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্তকালে জনৈক মো. আবদুল রশিদ (৫৫) ও মো. আবদুর রশিদকে (৩৫) গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে মো. আবদুল রশিদ নিজেকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দিতে জানা যায়, তিনি এবং মো. আবদুর রশিদসহ (৩৫) মোট ১১ জন মিলে পূর্বশত্রুতার জের ধরে শ্যামল দাসকে হত্যা করে লাশ বুধাইবুড়ী বিলে ফেলে দেন। অন্যদিকে এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ২০০৬ সালে ৩১ আগস্ট নান্দাইল থানায় হওয়া জনৈক রাশিদ মেকারের অপমৃত্যু মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। অপমৃত্যু মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে রাশিদ মেকার আত্মহত্যা করেছেন মর্মে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেন। পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে, শ্যামলকে হত্যার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় রাশিদ মেকার সবাইকে চিনে ফেলেন। পরে হত্যাকারীরা শ্যামল হত্যা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এবং সাক্ষী নির্মূল করার জন্য রাশিদ মেকারকে হত্যা করেন। পরে রাশিদের লাশের গলায় দড়ি পেঁচিয়ে গ্রামের কাছে নরসুন্দা নদীর পাড়ে আমগাছে ঝুলিয়ে রাখে। পিবিআইর তদন্তে একই সঙ্গে শ্যামল দাসের হত্যা মামলাটির রহস্য উদ্ঘাটিত হয় এবং রাশিদ মেকারের আত্মহত্যার মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে প্রকাশিত হয়। পিবিআই বিধিমালায় এ সংস্থাকে ১৫ ধরনের মামলা তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খুন, ডাকাতি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, চোরাচালান, কালোবাজারি, মানব পাচার, সাইবার ক্রাইম, ধর্ষণ, অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্য-সংক্রান্ত মামলা। পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, বিধিমালা জারির আগেই পিবিআই দেশের সব মহানগর, বিভাগীয় শহর, বৃহত্তর জেলাগুলোতে তাদের আঞ্চলিক অফিস স্থাপনের কাজ শেষ করে। নরসিংদী জেলার এক আদালতের নির্দেশে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি পিবিআই তাদের ইতিহাসের সর্বপ্রথম মামলাটি তদন্তের জন্য গ্রহণ করে। তাদের তদন্তের মান, ধরন ও আদালতে উপস্থাপিত পুলিশ প্রতিবেদনে একাধিক আদালত অর্ডারশিটে পিবিআইর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। কর্মকর্তারা আক্ষেপ করে বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পিবিআই নিজস্ব বিধিমালা পেলেও এখন মামলা পাওয়া যাচ্ছে না। এ মামলার জন্য এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে বিভিন্ন থানা পুলিশের সঙ্গে। কারণ থানা পুলিশ কোনো মামলাই হাতছাড়া করতে চায় না।

সর্বশেষ খবর