ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অর্থ লেনদেনের বিষয় খতিয়ে দেখা শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) খুনির বোরকা উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া হত্যা মামলায় গ্রেফতার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, হত্যা ঘটনায় থানা পুলিশের গাফিলতি পেয়েছে পুলিশ সদর দফতরের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। ঘটনার নেপথ্যে পরোক্ষ ভূমিকার কারণে ফেঁসে যেতে পারেন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। অন্যদিকে রোমহর্ষক এ ঘটনায় অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় আসামি জোবায়েরের পরিহিত বোরকাটি উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অন্যদিকে, মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই আসামি কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন গতকাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে। পিবিআইর পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. শাহ আলম জানান, আসামির পরিহিত বোরকাটি এ হত্যা মামলার অন্যতম আলামত। উদ্ধার হওয়ায় এটি মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখবে। এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ কাজে অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়টি জানার পর একটি টিম পাঠাচ্ছি ফেনীর সোনাগাজীতে। সত্যতা পেলে মামলায় যাব। জানা গেছে, নুসরাত হত্যার ঘটনা খতিয়ে ডিআইজি রুহুল আমিনের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি পুলিশ, নুসরাতের পরিবার, মাদ্রাসার শিক্ষকসহ মোট ২৬ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। তাদের মধ্যে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের টিমকে নুসরাতের ভিডিও কীভাবে ফেসবুকে ছড়িয়েছে, এর সদুত্তর দিতে পারেননি। গতকাল ডিআইজি রুহুল আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আমাদের কাজটি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে করার চেষ্টা করছি। আমাদের প্রতিবেদনে সার্বিক বিষয় উঠে আসবে। শ্লীলতাহানির ঘটনা থেকে হত্যাকা এবং মামলা রুজু হওয়ার ঘটনা সবকিছু। তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, নুসরাত হত্যাকাে র ঘটনায় সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পৌর কাউন্সিলর ও থানার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রিন্সিপালের অর্থ লেনদেন হয়েছিল বলে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা আছে। এরই মধ্যে নুসরাতের পরিবার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার শিক্ষকদের গাফিলতির কারণে পরিস্থিতি হত্যাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এ ঘটনায় থানা পুলিশের গাফিলতি থাকার তথ্য পেয়েছে।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে প্রচারের জন্য লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে এই অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে। তারা নুসরাতের শ্লীলতাহানি ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আর্থিকভাবে লাভবান ব্যক্তিদের তালাশ করছেন। সিআইডির অনুসন্ধান টিম ঘটনায় অভিযুক্তদের ব্যাংক লেনদেনের হিসাব খুঁজছেন। আলোচিত এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। এর মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।এর আগে হত্যা মামলায় গ্রেফতার নূরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা যায়, বোরকা পরে পাঁচজন এ হত্যাকাে অংশ নিয়েছিল। তার একটি হচ্ছে এই বোরকা। বোরকার সরবরাহকারী মনিকে নিয়ে শুক্রবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ভবনের ছাদ ও বোরকার দোকান পরিদর্শন করে পিবিআই। এর আগে শুক্রবার দুপুর ১২টায় পিবিআই কর্মকর্তারা মনিকে নিয়ে প্রথমে উপজেলা সদরের জিরো পয়েন্ট এলাকায় মানিক মিঞা প্লাজার একটি দোকানে যান, যেখান থেকে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় আসামিদের পরনে থাকা বোরকাগুলো কেনা হয়েছিল।
আরও দুজন গ্রেফতার : নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ কথা জানিয়েছে। এ নিয়ে এই মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়াল ২১ জনে। পিবিআই সূত্র জানায়, সর্বশেষ যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেনÑ এমরান হোসেন মামুন ও ইফতেখার হোসেন রানা। মামুনকে গতকাল কুমিল্লার পদুয়ার বাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর ইফতেখারকে গ্রেফতার করা হয়েছে পার্বত্য রাঙামাটির টিঅ্যান্ডটি কলোনি থেকে।
ফেনী, মেহেরপুর ও নেত্রকোনায় মানববন্ধন ও মশাল মিছিল : নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে মশাল মিছিল করেছে জেলা স্বেচ্ছাসেবী পরিবার। গতকাল সন্ধ্যায় ফেনী ট্রাংক রোডের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে পথচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সারা দেশে ধর্ষণ, শিশুহত্যা, অপহরণ বন্ধসহ ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারী সিরাজ-উদ-দৌলা ও তার সহযোগীদের ফাঁসির দাবিতে গতকাল মেহেরপুরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে অংকুর নামের ছাত্র কল্যাণমূলক একটি সংগঠন। মেহেরপুর প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন লেখক ও সাংবাদিক সুখী ইসলাম।
বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সভাপতি নাসিম নেজা বাঁধন, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ রহমান সান, সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মুন, সহ-সভাপতি হুসাইন কাদের সাজুসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। নুসরাত হত্যায় জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নেত্রকোনার গ্রামীণ নারীদের মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়ন নেটওয়ার্ক দল গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়ন নারী দল, মানবাধিকার সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধনে ইউনিয়নের শতাধিক নারী-পুরুষ অংশ নেন।