শনিবার, ১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাস্টারপ্ল্যান নেই শিক্ষা খাতে

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও আকতারুজ্জামান

শিক্ষা খাত নিয়ে সরকারের কোনো মহাপরিকল্পনা না থাকায় শিশু-কিশোররা গিনিপিগে পরিণত হয়ে চলেছে। যেমন শিক্ষাবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাওয়ার পর গত বছরের এপ্রিলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার (পিইসি) শিক্ষার্থীরা জেনেছে, তাদের প্রশ্নপত্রে ভিন্নতা আসছে এবং পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) থাকবে না।

অথচ এমসিকিউ রেখে এর দুই মাস আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর ঠিক করেছিল জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। এর দুই মাস পর হঠাৎই এমসিকিউ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা খাত নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা নেই সরকারের। সরকার বা মন্ত্রী পরিবর্তন হলে পরিবর্তন হয় পাঠ্যবই। এ ছাড়াও কারণে-অকারণে বছর বছর পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টে আসে পরিবর্তন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় ঘন ঘন পাল্টাচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতি। একটি পদ্ধতি ঠিকমতো কার্যকর না হতেই আবার আসছে নতুন পদ্ধতি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ঠিকভাবে এসব পদ্ধতি রপ্ত করার আগেই আবার আসছে নতুন সিদ্ধান্ত। নতুন এসব পদ্ধতির সঙ্গে তালমেলাতে না পেরে বিপত্তিতে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গিনিপিগের মতো নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে             তাদের ওপর।গত ১৪ বছরের শিক্ষা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমকি স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন পাঠ্যবই বদল হয়েছে সাতবার। বিভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতি বদলেছে চারবার, একাদশে ভর্তি পদ্ধতি একবার ও খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলেছে দুবার। এ ছাড়া পদ্ধতি বদলের ঘোষণা দিয়েও সেখান থেকে সরে এসেছে বেশ কয়েকবার। এর ফলে বারবার বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের। বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর, নতুন মন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর এবার স্কুল ও মাদ্রাসার কারিকুলামে ফের আসছে পরিবর্তন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা নতুন তথ্যসমৃদ্ধ বই হাতে পাবে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় আগে প্রথম অংশে লিখিত ও পরের অংশে এমসিকিউ পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ২০১৫ সালে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারবিষয়ক এক সভায় নেওয়া হয় আরেক নতুন সিদ্ধান্ত। বলা হয়, প্রথমে শিক্ষার্থীরা এমসিকিউ ও পরে দ্বিতীয় অংশে পরীক্ষার্থীরা লিখিত পরীক্ষা বা সৃজনশীল অংশের পরীক্ষা দেবে। একই সঙ্গে এমসিকিউ পরীক্ষার নম্বরও কমিয়ে আনা হয়। এই ১০ নম্বর যোগ করা হয় সৃজনশীল অংশে। বর্তমানে মাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ে ৩০ নম্বরের এমসিকিউ ও ৭০ নম্বরের বহুনির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী, সচিবরা এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতি বন্ধের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও এটি এখনো বাস্তবায়ন করেনি সরকার। এ ছাড়া গণিতেও বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু রয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে এসে শিক্ষার্থীদের বুঝে পড়া উৎসাহিত করতে সরকার গত ২০০৮ সালে চালু করে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। বলা হয়েছিল, সৃজনশীল প্রশ্নের গঠন কাঠামো শিক্ষার্থীর পরীক্ষাভীতি দূর করবে। কিন্তু সৃজনশীল নিয়ে খোদ শিক্ষকদেরই ভীতি কাটেনি। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করতে গিয়ে শেখাতে পারছেন না শিক্ষার্থীদের। প্রশ্ন তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরা প্রশ্ন করতে না পেরে বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করছেন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে নিচ্ছেন সৃজনশীলের পরীক্ষা। শিক্ষকদের অযোগ্যতায় মাঠেই মারা যাচ্ছে এই শিক্ষা পদ্ধতি। ভেস্তে যাচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য। শিক্ষকদের এ পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দেওয়ায় সৃজনশীল চালু হওয়ার ১১ বছর পরও এ পদ্ধতি চলছে জোড়াতালি দিয়েই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে সেটিও ঠিক নয়। সৃজনশীলের এ প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন প্রণয়ন একটি কাঠামোর মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কারণ, আরও অনেক পদ্ধতিতে সৃজনশীল প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্নের কাঠামোর কারণেই সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অতিরিক্ত বই পাঠ্যভুক্ত না করার ব্যাপারে এনসিটিবি বছরের শুরুতেই গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সতর্ক করে। কিন্তু এরপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও আদালতের রায়ের পরও শিশুদের পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমছে না। বরং সরকার অনুমোদিত বই ছাড়া হরেক রকমের বই শিশুপাঠ্যভুক্ত করছে এক শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিশুরা বইয়ের ভারী ব্যাগ বহন করতে বাধ্য হচ্ছে। আড়াই বছর আগে এ রায় দিয়ে একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাই কোর্ট। সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো বই পাঠ্য করা যাবে না- এমন নির্দেশনা থাকলেও এনসিটিবির বইয়ের বাইরে অনেক বই পাঠ্য করা হচ্ছে। ফলে শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ আনন্দময় না হয়ে বিষাদময় হয়ে উঠছে।

২০১৭ সালে মাধ্যমিক স্তরের ১১টি পাঠ্যবই সুখপাঠ্য ও পরিমার্জন করে তখনকার শিক্ষামন্ত্রীর হাতে তুলে দেয় শিক্ষাবিদরা। বলা হয়েছিল ক্রমে সব পাঠ্যবই সহজবোধ্য করে লেখা হবে। কিন্তু সব বই সুখপাঠ করা হয়ে ওঠেনি। এ ছাড়া প্রায় প্রতিবছর নতুন পাঠ্যবইয়ে নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য বিপাকে ফেলছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। পাঠ্যবই নিয়ে যথাযথ গবেষণা না থাকা, কনটেন্ট তৈরিতে অসতর্কতার ফলে ভুল পাঠ্যবই পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এ শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০১৬ সালের মে মাসে সচিবালয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এক সভায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন করার সিদ্ধান্ত হয়। বলা হয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা এখন গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। কিন্তু এ পর্যন্ত এটি কার্যকর হয়নি। বন্ধ হয়নি পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও। ফলে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় নাজেহাল হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও।

শিক্ষা নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান না থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা নিয়ে। পরিকল্পনার মাধ্যমেই নানা পরিবর্তন আনা হয় শিক্ষা সেক্টরে।

 

সর্বশেষ খবর