বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

উত্তেজনায় থমথমে কাশ্মীর

পাকিস্তানি কাশ্মীর ও চীনের আকসাইকেও নিজেদের দাবি ভারতের

নয়াদিল্লি প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক প্রতিবেদক

উত্তেজনায় থমথমে কাশ্মীর

জম্মুতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রহরা -এএফপি

ভারতশাসিত কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের এক দিন পরও ওই এলাকা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া টেলিফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করা হয়নি। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করা কাশ্মীরের রাস্তায় হাজার হাজার সেনা টহল দিচ্ছে। এরই মধ্যে গতকাল নয়াদিল্লির পার্লামেন্টে দেওয়া বিবৃতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ। এর মধ্যে পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীর ও আকসাই চীনও রয়েছে। গতকাল লোকসভায় জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এ ছাড়া এদিনই জম্মু ও কাশ্মীর সংরক্ষণ (দ্বিতীয় সংশোধন) বিলও পেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ নিয়ে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। কংগ্রেসের এই আপত্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করে অমিত শাহ বলেন, সংসদে তার পেশ করা বিল ও নিষেধাজ্ঞাগুলো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে যুগ যুগ ধরে ভারতের অবিচ্ছিন্ন অংশ করে রাখবে। তিনি বলেন, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, পুরো জম্মু ও কাশ্মীরই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর এবং আকসাই চীন ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ জানিয়ে অমিত শাহ বলেন, ‘প্রয়োজনে এ জন্য প্রাণ দিতেও আমরা রাজি। এ নিয়ে কোনো ধরনের আইনি বিতর্কেরও অবকাশ নেই।’

জানা যায়, ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই সম্পূর্ণ কাশ্মীরের অধিকার দাবি করলেও দুই দেশই রাজ্যটির কিছু নির্দিষ্ট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতশাসিত কাশ্মীরে অনেক দিন ধরেই বিদ্রোহ হয়ে আসছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী বিরোধপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে আকসাই চীন। ভারতের মতে, এটি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখের অংশ। অপর পক্ষ চীনের মতে, আকসাই চীন তাদের জিংজিয়াং প্রদেশের অংশ। গতকাল লোকসভায় জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির নেত্রী সুপ্রিয়া সুলে প্রবীণ নেতা ফারুক আবদুল্লার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে তাকে আটকে রাখার ইঙ্গিত করেন। এ সময় অমিত শাহ বলেন, ফারুক আবদুল্লাহকে আটক বা গ্রেফতার কোনোটাই করা হয়নি। তিনি নিজের ইচ্ছাতেই বাড়িতে রয়েছেন। তবে ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ফারুক আবদুল্লাহ শ্রীনগরে বসে এনডিটিভিকে বলেছেন, ‘আমাকে আমার বাড়িতে আটক করা হয়েছিল। আমি দুঃখ বোধ করছি যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ রকম মিথ্যা বলতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির দরজায় একটা বড়সড় তালা লাগানো হয়েছে। তারপর নিরাপত্তারক্ষীরা ঘেরাও করে রেখেছে বাড়ি। আমি তাদের (নিরাপত্তারক্ষীদের) বলেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন আমাকে আটক করা হয়নি। তাহলে আপনারা আমাকে আটকে রাখছেন কেন?’ ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার রাজ্যকে যখন পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যখন আমার লোকদের জেলখানায় মৃত্যুদ- কার্যকর করা হচ্ছে, তখন আমি কেন নিজের ইচ্ছায় বাড়ির ভিতরে থাকব?’ বার্তা সংস্থা বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে নেওয়ায় সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু এমন ঘোষণায় সেখানকার মানুষ কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এখন পর্যন্ত এর কিছুই জানা যায়নি। কারণ স্থানীয় নেতাদের এরই মধ্যে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া পুরো এলাকা রয়েছে জনবিচ্ছিন্ন। ভারতশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের বিবিসি সংবাদদাতা আমির পীরজাদা সোমবার দিল্লির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ‘রাজ্যের অন্যান্য অংশে কী হচ্ছে তা কেউ জানে না। আমরা কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছি না। মানুষ ভীষণ চিন্তিত। তারাও জানে না আসলে এখন কী হচ্ছে এবং কী হতে যাচ্ছে।’ ভারতের অন্যান্য স্থানে থাকা কাশ্মীরিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না এবং সে বিষয়ে তাদের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। দিল্লিতে থাকা এক কাশ্মীরি ছাত্র ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে জানিয়েছেন, তিনি স্থানীয় পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর, রবিবার রাতে দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহকে গৃহবন্দী করার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সময় থেকেই কাশ্মীরের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সে সময় থেকে ওই অঞ্চল কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখান থেকে কোনো কিছুরই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ঘোষণার পর অতিরিক্ত সেনাও মোতায়েন করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কখন ঠিক হবে, সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। তবে স্থানীয়ভাবে পাওয়া খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষকে ওই অঞ্চলে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয়রা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কয়েক মাসের খাবার মজুদ করে রাখেন। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে ধারণা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্যাটেলাইট ফোন বরাদ্দ করা হয়। অবশ্য অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিলোপের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন আগে থেকেই কাশ্মীর উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সংসদে ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন আগে ওই অঞ্চলে অতিরিক্ত ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিত, সেটিই ছিল রাজ্যটির ভারতের অংশ থাকার পেছনে প্রধান যুক্তি। এখন এ অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে দিল্লির সঙ্গে কাশ্মীর অঞ্চলের সম্পর্কের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৭০ কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার সুযোগ দিত। এর মাধ্যমে তারা নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন প্রণয়নের অধিকার রাখত, যদিও পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্ত, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। ফলে জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখত। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষকে কাশ্মীরিরা জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা থেকেও বিরত রাখতে পারত ওই অনুচ্ছেদের বদৌলতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর