শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

জ্বালানি সংকটে লোডশেডিং

♦ ডলার সংকটে মিলছে না জ্বালানি ♦ তাপমাত্রা না কমলে লোডশেডিংও কমবে না ♦ কয়লার অভাবে আজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে পায়রার দ্বিতীয় ইউনিট

জিন্নাতুন নূর

জ্বালানি সংকটে লোডশেডিং

তাপপ্রবাহের সঙ্গে দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও ডলার ও জ্বালানি সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর ফলে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তাই দেশজুড়ে দিন-রাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা আর গ্রামাঞ্চলে সাত থেকে সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডলার সংকটে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও কয়লা আমদানি কমায় চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়লার অভাবে আজ দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটও বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ডলার সংকট, জ্বালানি ঘাটতি ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৪৫ শতাংশই এখন  অব্যবহৃত থাকছে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। কিন্তু গত ২৪ থেকে ২৯ মে দেশে দিনে গড়ে ১১ হাজার ২০০ এবং সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে ১৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহে তীব্র লোডশেডিং হয়। মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় সাময়িক স্বস্তি মিললেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আবারও লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। তীব্র গরমে ঘন ঘন লোডশেডিং হওয়ায় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পার করছে নির্ঘুম রাত। গরমের কারণে অনেকে চার্জার ফ্যান ও এসি কিনছেন। বাসাবাড়ি ও অফিসে জেনারেটর চালাচ্ছেন কেউ কেউ। লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীতে এখন ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত দফায় দফায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, খুলনা ও রাজশাহীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যে, গ্রামের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে এখন রাজধানীতেও একাধিকবার লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার দুই বিতরণ সংস্থা বলছে, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি সমন্বয় করতে এখন লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আর  গরম না কমা পর্যন্ত এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ পরিদফতর) মো. শামীম হাসান বলেন, তাপমাত্রা কমে এলে বা একপশলা বৃষ্টি হলেই বিদ্যুতের চাহিদা তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট কমে আসবে। এ ছাড়া আপাতত নাটকীয় কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কোনো নতুন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে দুই সপ্তাহের মধ্যে আসবে এমন সম্ভাবনাও নেই। অর্থাৎ খুব তাড়াতাড়ি লোডশেডিং নিয়ে স্বস্তির কোনো খবর নেই।

তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হওয়ায় গত কয়েক দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে দেড় থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। আবার রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় লোডশেডিং আরও বেশি হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা, গ্যাস ও তেলের অভাবসহ রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ৫০টির অধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বন্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট হলেও গত ২৪ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার ২৯৫ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়নি জ্বালানির অভাবে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। গত ১ জুন দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট আর সরবরাহ করা হয় ১৪ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় ১ হাজার ৩০৫ মেগাওয়াট। আর গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয় ১১ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় ১ হাজার ৪৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট কিন্তু গ্যাস স্বল্পতার কারণে গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে ৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট। অন্যদিকে ফার্নেস তেল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু গত কয়েক দিনে গড়ে উৎপাদন করা হয়েছে দৈনিক ৩ হাজার ৮০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। উৎপাদিত হচ্ছে ২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট। ডলারের অভাবে বিল বকেয়া পড়ায় কয়েক মাস ধরে কয়লা কিনতে না পারায় দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রার একটি ইউনিট গত ২৫ মে বন্ধ হয়ে যায়। মজুদ শেষ হওয়ায় আজ দ্বিতীয় ইউনিটটির বন্ধ হয়ে  যাওয়ার কথা। এ কেন্দ্র থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায় আর এটি বন্ধ হলে লোডশেডিং আরও বৃদ্ধি পাবে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই কয় দিন আমরা গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ দিয়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। কিন্তু তারপরও চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য রয়ে গেছে। অত্যধিক গরমের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বহুল হওয়ায় আমরা কম ব্যবহার করি। পিক আওয়ারে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো হয়। সাধারণত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো রাতে চালানো হয়। ফলে দিনে লোডশেডিং করতে হয়। রাতে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিনের চেয়ে বেশি লাগে। ফলে তখন লোডশেডিংও বেশি হয়। একদিকে বৈশ্বিক সংকট অন্যদিকে পরিবেশও আমাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে। দুটো মিলিয়ে লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়লা নিয়ে আগের যে সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়েছে তা ভবিষ্যতে আর পড়তে হবে না বলে আশা করছি। আগের থেকে জ্বালানির দাম ও ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আজও (গতকাল) সারা দেশে আড়াই থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর