প্রকৃত বন্ধু কে? সরাসরি এই প্রশ্ন না তুললেও দু'মাস আগে মিয়ানমার সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন, ভারতই তাদের আসল বন্ধু। অং সান সু চি এবং রাষ্ট্রপতি থিন কাওয়ার সঙ্গে একান্ত বৈঠকেই শুধু নয়, প্রকাশ্যেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে গিয়েছেন, ভারতের জনগণের করের টাকায় মিয়ানমারে যে রাস্তা, সেতু, বন্দর তৈরি হচ্ছে সেগুলো নির্মাণের পর এদেশের সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
ভারত সরকারের হাতে কোনও অংশীদারী বা মালিকানা থাকবে না। নরেন্দ্র মোদির সেই বক্তব্যকেই মিয়ানমারবাসীর সামনে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। লক্ষ্য, মিয়ানমারের বর্তমান সরকারকে তাদের চীন নীতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা।
সেই লক্ষ্যপূরণেই মিয়ানমারস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিশ্রি দু'দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় উত্থাপিত নানা প্রসঙ্গে দর্শকাসনে বসেই ভারত সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন। মোদির বক্তব্যের রেশ ধরেই মিশ্রি এ দিন বলেন, 'ভারত সরকারের টাকায় তৈরি যাবতীয় সম্পদের মালিক মিয়ানমারের জনগণ। মিয়ানমারের বাকি প্রতিবেশিরা কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলছে না।'
মুখে নাম না নিলেও মিশ্রির বক্তব্যের লক্ষ্য হল চীন। এই মুহূর্তে মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ভারতের প্রায় সাত গুণ। কিন্তু চীনা বিনিয়োগের সিংহভাগই বেসরকারি পুঁজি। চীন তার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনও বিনিয়োগই করছে না।
এমনকী যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পগুলোতে তারা ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা নিজেদের দখলে রাখছে। মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে জঙ্গি মোকাবেলা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সেই কারণে মিয়ানমারের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে সে দেশে পরিকাঠামো গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারত।
কিন্তু মিয়ানমারের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা যার হাতে, সেই অং সান সু চি, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এ দেশে চীনের প্রভাব বেড়েছে। সু চিও নয়াদিল্লির পরিবর্তে প্রথম বেইজিং সফরে গিয়ে চীনকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অথচ বিরোধী নেত্রী থাকাকালে তার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ভারত পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল।
ভারত তাই পাল্টা কৌশল নিয়েছে। নয়াদিল্লির উদ্দেশ্য হল, চীনের বন্ধুত্বকে মিয়ানমারবাসীর প্রশ্নের মুখে ফেলা। এ দেশে ভারতীয় বিনিয়োগ কেন কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না, কেন ভারতীয় বণিকদের অনীহা, তার জবাবে রাষ্ট্রদূত মিশ্রি খোলাখুলি বলেন, 'সব দেশের বিনিয়োগকারীকে এখানে সমান দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে না। তার কথায়, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিতে তৈরি। কিন্তু মিয়ানমারকেও তাদের অবস্থান বদলাতে হবে।'
মিয়ানমারের নাগরিক সমাজ যে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে এ দিন তার ইঙ্গিত মিলেছে আং তু থেতের কথায়।
বিশ্বব্যাংকের এই প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে। একদা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেত বলেন, 'মায়ানমারের আঞ্চলিক সরকারগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের বলা হয়েছে- দ্রুত বিশেষ অর্থনৈতির অঞ্চল (সেজ) গড়ে তুলতে। যাতে দ্রুত ছোট বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগ করতে পারে।'
প্রসঙ্গত, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ভারত সরকারও এদেশে সেজ গড়ে তোলার পক্ষপাতি। উদ্দেশ্য দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে নিয়মের বেড়িকে দ্রুত শিথিল করতে বাধ্য করা।
এদিনের আলোচনায় মিয়ানমারে ভারতীয় বিনিয়োগের পক্ষে সওয়াল করেন মিয়ানমার ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রধান উপদেষ্টা উ কিং মং। এদিনই মিয়ানমার সরকারের শিল্প বাণিজ্য দফতরের পক্ষে আলোচনা সভায় পেশ করা হয়েছে বর্তমান সরকারের শিল্প-পরিকাঠানোমুখী পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কথা।সূত্র: এই সময়।
বিডি প্রতিদিন/১২ নভেম্বর ২০১৭/আরাফাত