শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

নকল পণ্যের এলাকা কোতোয়ালি

মাহবুব মমতাজী

নকল পণ্যের এলাকা কোতোয়ালি

৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কোতোয়ালি থানা এলাকা। এটি নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। যেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাইকারি বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করা এমনকি বাবুবাজার বৃহৎ চালের বাজারটিও এখানে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড। মিটফোর্ড হাসপাতাল, কমিটিগঞ্জ, নলগোলা, জুমরাইল লেন, গোপিনাথ দত্ত কবিরাজ স্ট্রিট, রায় বাহাদুর ঘোষ স্ট্রিট, পিক রায় লেন, জিন্দাবাহার লেন, সৈয়দ হাসান আলী লেন, বাবুবাজার, চৌধুরীবাড়ীর কবরস্থান রোড, কাজী জিয়াউদ্দিন রোড, আকমল খান রোড, শাহজাদা মিয়া লেন, হায়বতনগর লেন, বাদামতলী, তাঁতীবাজার, বাঁশিচরণ সেন পোদ্দার লেন, হরিপ্রসন্ন মিত্র রোড, উচ্ছব পোদ্দার লেন, নবরায় লেন, ইসলামপুর রোড, রায় সাহেব বাজার, জজকোর্ট, কোর্ট হাউস স্ট্রিট, কৈলাস ঘোষ লেন, শাঁখারীবাজার, আহসান উল্লাহ রোড, ইসলামপুর রোড, কুমারটুলী লেন, জিএল গার্থ লেন, ওয়াইজঘাট রোড, নবাববাড়ী পুকুরপাড়, পাটুয়াটুলী রোড, কবিরজ গলি ও রমাকান্ত নন্দী লেন এবং সদরঘাট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও এলাকা পড়েছে এ অঞ্চলে। এ ছাড়াও এ এলাকায় রয়েছে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও পগোজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। প্রচীন নিদর্শন ও ঐতিহ্য আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউস ও শাঁখারীবাজারের শতাধিক পুরনো ভবন। তবে এখানকার আবাসিক ব্যবস্থা ইসলামপুর, শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারের চিপাচাপা কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ২ নম্বর লালকুঠির জগন্নাথদেব শিব মন্দিরের সামনের দিকের রাস্তাটিই হলো শ্যামবাজারের বেড়িবাঁধ সড়ক; যা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে আছে দীর্ঘদিন। এসব আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। ফলে এ সড়কের ফুটপাথ দিয়েও চলাচল করতে পারছেন না পথচারীরা। শ্যামবাজারে (কাঁচাবাজার) ময়লা-আবর্জনা রাখার নির্দিষ্ট স্থান বা পাত্র না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

কাঁচা তরিতরকারির সব আবর্জনা বুড়িগঙ্গার ১১ নম্বর জামাল হাউস ও ১১ নম্বর ফরাসগঞ্জ রোডের সামনে ফেলা হয়। এতে নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে। আর বেড়িবাঁধ সড়কের এ বেহাল অবস্থার কারণে এক যুগের বেশি সদরঘাট থেকে পোস্তগোলায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ সুযোগে লালকুঠির ঘাট থেকে শ্যামবাজারের কচুঘাট ও ফরাসগঞ্জ মসজিদ এলাকা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত সড়কের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে ভ্রাম্যমাণ খাবার হোটেল বসিয়ে চলছে বাণিজ্য। দেশের অন্যতম সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাটে গ্রীষ্মের মৌসুমি ফলের বিপুল সমাহার। প্রতিটি আড়ত ও পাইকারি দোকানে বিভিন্ন ফল-ফলারি দিনরাত আনা-নেওয়া করায় ব্যাক ল্যান্ড বাঁধ রোডটি ট্রাকে তীব্র যানজটের সৃষ্টি করেছে। এমনকি সাধারণ মানুষের পা ফেলার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। বাবুবাজার সেতু এলাকা থেকে সদরঘাট যাওয়ার প্রধান সড়ক দুটি হলো ইসলামপুর ও বাদামতলী। তবে বাদামতলী রোডে এলোমেলোভাবে ফলবাহী কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক রাখায় এ তীব্র যানজট। আর ইসলামপুরে রিকশার জট তো নিত্যদিনের সঙ্গী। বাদামতলী রোডের দুই পাশে ফুটপাথ দখল করে গড়ে তোলা দোকানপাটও যানজটের অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জানা যায়, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য খ্যাত ১৮৭২ সালে নির্মিত নর্থব্রুক হলটি লালরঙে রাঙানো ছিল। পরে এ হলটিকে লালকুঠি নামে ডাকা হতো। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে লালকুঠির প্রবেশদ্বারের মাঝামাঝি একটি ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ নভেম্বর নির্মিত ৮ কোণাকৃতির ফোয়ারাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায় যত্নের অভাবে; যা ১৭ বছর যাবৎ পরিত্যক্ত হয়ে আছে।

অভিযোগ পাওয়া যায়, এ এলাকায় সিটি করপোরেশনের অধীনে ৫/৬ মসজিদ মার্কেটের পূর্ব পাশে একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এটি চালু না করেই এর দ্বিতীয় তলায় নিজের বিলাসবহুল কার্যালয় স্থাপন করেছেন ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। আর এ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে সদরঘাটের ফাঁকা জায়গাটিতে গাড়ি রাখা বাবদ ৩০-৬০ টাকা করে চাঁদা তোলেন ঘাট শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীরা। আর এতে নেতৃত্ব দেন জাবেদ হোসেন মিঠু। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার পরে কমিউনিটি সেন্টারে এসব চাঁদার ভাগবাটোয়ারা হয়। এ ছাড়াও চিত্তরঞ্জন এভিনিউর ফুটপাথের চাঁদাবাজিতে নেতৃত্ব দেন থানা আওয়ামী লীগের এক সাবেক নেতা। ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিশনের সামনে লেডিস পার্ক মার্কেটের ভিতরে তিনি স্থাপন করেছেন জাঁকজমকপূর্ণ কার্যালয়। আরও অভিযোগ পাওয়া যায়, তাদেরই ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সদরঘাটের কুলিরা কোনো ধরনের মূল্য তালিকা না মেনে যাত্রীদের মালামাল জিম্মি করে ইচ্ছামতো মজুরি নেন। পানি সংকটের কারণে ইসলামপুর আহসান উল্লাহ রোডে এবং পাটুয়াটুলী ফায়ার সার্ভিসের প্রধান ফটকে প্রতিদিন মানুষ লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করে। গাবতলী থেকে সদরঘাটে মানুষের দ্রুত আসা-যাওয়ার জন্য ২ নম্বর ওয়াইজঘাটে ওয়াটারবাস চালু করা হলেও তা এখন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। গুলশান আরা সিটি মার্কেটের সামনে আহসান উল্লাহ সড়কটি বেহাল হয়ে পড়ে আছে কয়েক মাস ধরে। ২ নম্বর কুমারটুলী সড়কটিতে নিয়মিত চলে মাদকের আড্ডা। লিয়াকত ও চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই খালি কনটেইনার ব্যবহার করে পেনটিন, ডাব, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, সানসিল্ক, ক্লিয়ারসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু এবং মেক্সি, এক্স ও ডয়েটসহ নামি ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে ও নকল লোশন ফেরি করে বিক্রি করা হয়। আহসান উল্লাহ রোডের চার অলির মাজারের পাশে বুড়িগঙ্গা ভবনের নিচে আম, কলা ও লিচুতে কালার আনার জন্য কীটনাশক মেশান ফল ব্যবসায়ীরা। ভেজাল ফলের পাশাপাশি রয়েছে নকল ওষুধ তৈরির কারখানা ও গোডাউন। ১৬ মে কোতোয়ালি থানার বাদামতলীতে ভেজাল ও পচা ফল-ফলারি জব্দে অভিযান চালায় র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় বেশ কয়েক বস্তা পচা খেজুর ধ্বংস এবং কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়। ২১ মে বাবুবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে কোটি টাকার বেশি ভেজাল আর নকল ওষুধ জব্দ করে র‍্যাব। এ সময় পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে জরিমানা করে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নকল ওষুধ তৈরির সময় কারখানাটির মালিক কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত আবদুল বারেককে গ্রেফতার করে তত্ক্ষণাৎ দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আরও অভিযোগ রয়েছে, হাবিব মার্কেটের জাহিদ, শরীফ ও বাবুলের নেতৃত্বে একটি চক্র ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধ চোরাপথে আমদানি করে। এ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণকারী গাইনোকোসিড নামে একটি ট্যাবলেট নিজেরা তৈরি করে বাজারজাত করে। নায়না মার্কেটের মনির খান ও আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে একটি চক্র বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ওষুধ নকল করে বাজারে ছড়াচ্ছে। সরদার মার্কেটের চুন্নু মিয়া, আলিয়ালাম মীম মার্কেটের সবুজ মিয়া, রিয়াজ মার্কেটের মোবাশ্বের আলী বিদেশি কৌটার মধ্যে নকল ওষুধ ভরে তা বিক্রি করেন। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবদুর রহমান মিয়াজী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদক ও ভেজাল প্রতিরোধে আমরা অত্যন্ত সচেষ্ট। আমরাও এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে মিটিং করছি।’

সর্বশেষ খবর