শনিবার, ১৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প

করোনা রোগী নিয়ে স্থানীয়দের উদ্বেগ প্রশাসনে উৎকণ্ঠা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম ও আইয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়াতে স্থানীয় অধিবাসী, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার আবাসস্থল উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি শরণার্থী ক্যাম্প এমনিতে এইচআইভি, হাম, পোলিও ও নানা রকম চর্মরোগজনিত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। ঘনবসতি ও অসচেতনতার কারণে এখানে করোনাভাইরাসও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন শরণার্থীকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। গতকাল আরও তিন রোহিঙ্গা শরণার্থীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শনাক্তদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মাধ্যমে ৩৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং ওই পরীক্ষায় দুজন করোনাভাইরাস পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। তবে তাদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তিনি কুতুপালং ক্যাম্পের অধিবাসী। অপরজন রোহিঙ্গা নন। তিনি উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন বলে তাকেও রোহিঙ্গা শরণার্থী মনে করা হয়েছিল। মূলত তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম কচুবনিয়া এলাকার বড়ুয়া পাড়ার বাসিন্দা।

জেলা সিভিল সার্জন জানান, আক্রান্ত দুজনের একজনকে আন্তর্জাতিক সংস্থা মেডিসিন উইদাউট বর্ডারস এবং অন্যকে আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার তত্ত্বাবধানে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শে যারা যারা এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, এমন আরও কয়েকজনকে আলাদা করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে অনেক ছোট জায়গায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাসের কারণেই এ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। যে কারণে ক্যাম্পগুলো গত ৪ মার্চ থেকে আংশিক ও ১৪ই মার্চ থেকে পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা না মেনে লকডাউন ভেঙে চলাচল করতে থাকে। এতে প্রশাসন ও স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। দীর্ঘ দুই মাসেরও অধিক সময় রোহিঙ্গাদের করোনামুক্ত রাখা গেলেও বৃহস্পতিবার সেখানেও থাবা বসিয়েছে মহামারী করোনাভাইরাস। গতকাল আরও তিনজনের করোনা শনাক্ত হলো। উখিয়া ইউএনও মো. নিকারুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এমনিতেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। তার ওপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক অবস্থানে ছিলাম আমরা। তাই ক্যাম্পের ১২টি সেন্টারে ১৯০০ জন রোগীকে আইসোলেশনে রাখার জন্য প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার শুরুতেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে লকডাউন করা হয়েছিল। পাশাপাশি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতায়াত। প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বাকি সব কার্যক্রম। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে ১৩২ জনে।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির জানিয়েছেন, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ল্যাব প্রতিষ্ঠার পর গত ৪৪ দিনে ৩ হাজার ৩৬২ জনের স্যাম্পল টেস্ট করা হয়েছে। পজিটিভ আসাদের মাঝে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৩ জন। আর শনাক্ত হওয়ার ৭ ঘণ্টার মাথায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মারা যান রামু উপজেলার কাউয়ার খোপ ইউনিয়নের পূর্ব কাউয়ার খোপ গ্রামের এক বৃদ্ধা। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মরজিনা আক্তার বলেন, আমরা শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে আছি। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের সচেতন করে তুলছি। কিন্তু গহিন ক্যাম্পের ভিতরে সব সময় নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয় না। এতগুলো মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখাও সহজ কাজ নয়। তাই একবার যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ভয়াবহ রূপ নেবে ক্যাম্পে- এটা নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন।

বালুখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখানে যে স্টাইলে চলাফেরা ও আমোদ-ফুর্তিতে আছে, সেভাবে তারা নিজেদের দেশেও ছিল না। তাই তারা ভাইরাস-টাইরাস এসব আমলে নেয় না। তারা নিজেদের মতো করেই চলছে। তাই আমরা আরও বেশি উদ্বিগ্ন যে এই মহামারী যে কখন এখানে কী রূপ ধারণ করে তাই নিয়ে।

সর্বশেষ খবর