বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

চামড়া ব্যবসায় সর্বনাশ

অনেকেই পুঁতেছেন মাটিতে, ভাসিয়েছেন নদীতে, ফ্রি দিলেও নেননি, ময়লার ভাগাড়ে স্তূপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চামড়া ব্যবসায় সর্বনাশ

এবার অন্য রকম প্রত্যাশা থাকলেও চামড়া ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের ফাঁদে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে চামড়া। ফলে এবার কোরবানিতে গরুর চমড়ার দাম উঠেছে ১০০ টাকা। আর ফ্রি দিলেও কেউ নেয়নি ছাগলের চামড়া। ফলে অনেকেই চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। হতাশা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায় তাদের ধস নেমেছে। এমন চিত্র ফুঠে উঠেছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে-

সাভার : সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে ঢুকতে শুরু করেছে পশুর চামড়া। তবে করোনা ও বন্যার কারণে বিগত বছরের তুলনায় এবার কাঁচা চামড়া সংগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ট্যানারি মালিকরা। রবিবার সকালে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরীর আশপাশের এলাকাগুলোতে চামড়া সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। সাভারের চামড়া ব্যবসায়ী পারভেজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ চামড়া মজুদ আছে। এ ছাড়া চামড়া জাতীয় সম্পদ বলেই সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনছি। ট্যানারি মালিকরা যদি একটু লাভ দিয়ে চামড়া নেন সেই আশাতে চামড়া কিনছি। ট্যানারি মালিকরা তো আমাদের পথে বসানোর পাশাপাশি দেশের চামড়া শিল্পটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।’ সাভারে হেমায়েতপুর এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী নবী হোসেন ব্যাপারী বলেন, ‘চাপের কারণে আমরা চামড়া কিনছি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই চামড়া কিনছি। কারণ বিভিন্ন এলাকার ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে চামড়া সরবরাহ করে আসছেন। তারাও এই আনন্দের দিনে গ্রামে গ্রামে গিয়ে চামড়া কিনে আমাদের কাছে সরবরাহ করেন। তারাও তো কিছু আশা করে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই চামড়া কিনছি। তবে সরকার ও ট্যানারি মালিকরা যদি আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দিতেন, তাহলে চামড়া শিল্প আবার তার ঐতিহ্য ফিরে পেত।’ বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, আর্থিক সংকটে থাকা ট্যানারির মালিকদের কাঁচা চামড়া কিনতে এবার চাহিদা মতো ঋণ দেওয়া হয়নি। আর্থিক সংকটে ঈদে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে চামড়া শিল্পে ভয়াবহ লোকসান চলছে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চামড়া কিনলেই হবে না। তা সংগ্রহ করে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপিজনিত সমস্যা এবং ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শেষ করা না হলে কাঁচা চামড়ার বর্জ্যে সাভার শিল্প নগরী দূষিত হয়ে যাবে। ট্যানারিতে পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতি বজায় না থাকলে বাংলাদেশের চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।’ চট্টগ্রাম : সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে এবার ‘মূল্যহীন’ ছিল কোরবানির পশুর চামড়া। প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে অনেক কোরবানিদাতা জবাই করা পশুর চামড়া পুঁতে দিয়েছেন মাটিতে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া ও ব্যাপারীদের যোগসাজশের কারণে চামড়া মূল্য পায়নি। খুলনা : খুলনায় পানির দরে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। ছোট আকারের গরুর চামড়া ১০০-১৫০ টাকা ও বড় আকারের গরুর চামড়া ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের প্রতিটি চামড়া বিক্রি হয়েছে ১৫-২০ টাকায়। এদিকে পানির দামে চামড়া কিনেও স্বস্তিতে নেই প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা। রাজশাহী : রাজশাহীতে এবার কোরবানির চামড়া বিক্রি হয়েছে পানির দরে। ছাগলের চামড়া ৫ থেকে ১০ এবং গরুর চামড়া ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার তারাই ঠিকমতো বাজার বুঝতে পারেননি। এক দিনের জন্য চামড়া কিনতে এসে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও বোঝেননি। ফলে তাদের লোকসান বেশি। সিলেট : সিলেটে এবারও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে হাহাকার করেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ক্ষোভে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া বিক্রি না করে রাস্তায় ফেলে যান। অনেকে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। অনেকে ফেলে দেন রাস্তা ও ডাস্টবিনে। সিলেট নগরী ছাড়া জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটসহ বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করতে না পেরে কোরবানিদাতারা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন।

বরিশাল : বরিশালে পশুর চামড়ার বাজারের বেহাল দশা। চামড়ার বাজারের ধস ঠেকাতে ধান সংগ্রহের মতো সরকারিভাবে চামড়া সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুর রহমান শাহিন। শনিবার নগরীতে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহকারীদের তৎপরতা শুরু হয়। রংপুর : সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হয়েছেন রংপুরের ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়ায় লবণ মাখিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামে এখন চামড়া বিক্রি করলে লবণের দামও উঠবে না। অন্যদিকে সোমবার পর্যন্ত খাসির চামড়া খুব একটা বাজারে ওঠেনি।

 সোমবার নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় চামড়াপট্টিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। রংপুর চামড়া ব্যবসায়ীর সভাপতি আবদুল লতিফ খান বলেন, ‘৫৩ বছরে চামড়ার এমন দরপতন দেখিনি। তিনি চামড়া শিল্প টিকিয়ে রাখতে সেদ্ধ চামড়া রপ্তানির অনুমতির জন্য সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সরকারের দেওয়া দামের চেয়েও কমে চামড়া কেনার পরও বিক্রি করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দাম না পেয়ে এরই মধ্যে পুঁজি হারানোর আশঙ্কায় পড়েছেন এসব ব্যবসায়ী।

সিফাত আবদুল্লাহ নামের চড়পাড়া মোড়ের এক মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, ‘কোরবানির পর প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে লবণ, গুদাম ভাড়া, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ মোট ব্যয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কিন্তু এখন আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়।’

কুমিল্লা : কুমিল্লায় পশুর চামড়ার তেমন দাম পাওয়া যায়নি। এতে হতাশ ক্রেতারা। ক্রেতা না পেয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করা হয় চামড়া। এতিমখানা কর্তৃপক্ষও তেমন দাম পায়নি। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মামীশ্বর হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম শাহীন জানান, তারা ৬৫টি চামড়া পেয়েছেন। প্রতিটি চামড়া গড়ে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। ছাগলের চামড়া আটটি পেয়েছিলেন। কেউ ফ্রিও নিতে চায় না। তাই মাটিতে পুঁতে ফেলেন। কুমিল্লা ঋষিপট্টির চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রতন ঋষি জানান, এ বছর সিন্ডিকেট না থাকলেও চামড়ার বৈদেশিক চাহিদা কম। তাই দর কম।

দিনাজপুর : ঢাকার বিভিন্ন ট্যানারি মালিকের কাছ থেকে পাওনা টাকা না পাওয়া, শ্রমিক ও লবণের খরচ এবং চামড়া বিক্রি নিয়ে দিনাজপুরে চামড়া ব্যবসায় ব্যাপক দরপতন ও ধস নেমেছে। ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। কারণ পরিবহনসহ লবণজাত করতে যে খরচ, বিক্রি করে তা উঠবে না। করোনার এই সময়ে চামড়া নিয়ে গত বছরের চেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গতকাল পর্যন্ত গরুর প্রায় ১৫ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ হয়েছে বলে জানান দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সভাপতি জুলফিকার আলী স্বপন। তিনি বলেন, ‘গরুর চামড়া ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় কিনেছি। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে এবার মাত্র ৫ শতাংশ টাকা পেয়েছি। এখনো প্রায় ৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর