সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকাই টমটম

মোস্তফা মতিহার

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকাই টমটম

ডালিমকুমারের রূপকথার ঘোড়ার সেই কল্পকাহিনি আজও মানুষের মুখেমুখে। হ্রেষা ধ্বনির সঙ্গে ঘোড়ার ক্ষুরে মরুর বুকে ধূলি উড়ানোর সেই দৃশ্য আজ বিরল হলেও ঘোড়া দিয়ে টানানো গাড়ি টমটম মিশে আছে ঢাকার ইতিহাসের অংশ হয়ে। আর পুরান ঢাকার টমটমের সঙ্গে মিশে আছে ঢাকার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ছিটেফোঁটা। রাজধানীর টমটমের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ঢাকার নবাবদের প্রধান বাহন হওয়াতে সাধারণের কাছে টমটম ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ১৮৫৬ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমের প্রচলন ঘটে। অতীতে রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িকেই প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। রণাঙ্গনের রসদ সরবরাহের প্রধান বাহনও ছিল এই টমটম। বিয়ে বা বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতায় টমটম থাকলেই অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হতো। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম ব্যবহার হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রায়, সিনেমার শ্যুটিংয়ে। এসব কাজে টমটম ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। কোচোয়ান ও হেলপারের জন্যও ওইসব অনুষ্ঠানের সময় রয়েছে বিশেষ পোশাক। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে ঘোড়ার গাড়িগুলো রঙিন করে সাজানো হয়। ফুলের মালা দিয়ে আর রঙিন কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সাজানো হয় ঘোড়া আর গাড়ি দুটিই। আধুনিকতার যাঁতাকলে ঢাকাই এই ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। ঘোড়া আছে, ঘোড়া দিয়ে টানানো গাড়ি টমটম ঠিকই আছে। কিন্তু ঘোড়ার কদর ও সমাদর দুটিই এখন অতীত। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পৈতৃক পেশা ছেড়ে অনেকে ভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাস, কার, অটোরিক্সাসহ নানা ধরনের যানবাহনের আধিক্যের কারণে এই বাহনের কদর বর্তমানে শূন্যের কোঠায়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী-১’ বই হতে জানা যায়, ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিল অন্যতম প্রভাবশালী ও বণিক সম্প্রদায় এবং ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় টমটমের প্রচলন করেন।  অর্থাৎ রাজকীয় এই বাহন টমটমের গর্বিত ইতিহাস প্রায় পৌনে দুইশ’ বছরের হলেও এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা বর্তমানে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যার কারণে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা এখন অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকছেন। বঙ্গবাজারের ভাই ভাই টমটম সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী মো. কালাম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঘোড়ার খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ, চালক ও হেলপারের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগানো সম্ভব হচ্ছে না বলে টমটমের ব্যবসা অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, আগে বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, পশু হাসপাতাল, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার, কেরানীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি রুটে প্রায় শতাধিক টমটম চলাচল করলেও এখন শুধু গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে মাত্র ৪০টি টমটম চলাচল করে। বেশ কয়েক বছর আগেও প্রতিটি টমটম দৈনিক প্রায় ৩ হাজার টাকার মতো আয় করলেও এখন মাত্র ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করে। প্রতিদিন একটি ঘোড়া প্রায় ৫০০ টাকার খাবার খায় আর টমটমের চালককে দিতে হয় ৩০০ টাকা আর হেলপারকে দিতে হয় ২০০ টাকা।  ঘোড়ার খাবার, চালক ও হেলপার বাবদ একটি গাড়ির পেছনে দৈনিক খরচ হয় ১ হাজার টাকার মতো। কিন্তু একটি গাড়ি দৈনিক আয় করে ৮০০ টাকা। অর্থাৎ রাস্তায় গাড়ি নামালে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় একজন মালিককে। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে গুনতে আমরা হাঁফিয়ে উঠেছি। শুধু ঐতিহ্য ও পৈতৃক ব্যবসা রক্ষার জন্য কোনরকমে টিকে আছি। আমাদের অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে। সরকারের কাছে আমরা একাধিকবার সহযোগিতা চেয়েও পাইনি। আমাদের টমটম মালিক সমিতির সভাপতি নাজির হোসেনের মাধ্যমে আগের মেয়র সাদেক হোসেন খোকার কাছে আমরা সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। বর্তমান সরকারের আমলেও আমরা একাধিকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ঢাকার প্রায় পৌনে দুইশ’ বছরের এই ঐতিহ্যকে রক্ষায় এই সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। সরকারি অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে রাজকীয় এই ঐতিহ্য অদূর ভবিষ্যতেই হারিয়ে যাবে বলে আমরা শঙ্কা প্রকাশ করছি। তিনি আরও জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের বাপ-দাদারা এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আগে ঘোড়া ছিল প্রায় ২০০টি, আর বর্তমানে ঘোড়া আছে মাত্র ৪০টি। অনেকেই তাদের ঘোড়া বিক্রি করে দিয়েছেন। এর মধ্যে লকডাউনের সময় না খেয়ে ৪/৫টি ঘোড়া মারা গেছে। লোকসান দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিস্তি উঠিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা করে নেওয়া হয়।  প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করে খরচ হয় ১ হাজার টাকা। যার কারণে বিয়ে-জন্মদিনসহ যেকোন সামাজিক অনুষ্ঠানের অপেক্ষাতেই আমরা থাকি। দূরত্ব ভেদে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় প্রতিটি টমটম ভাড়া দিয়ে থাকি। মূলত রিজার্ভের কারণেই আমরা কোনোরকমে টিকে আছি। রিজার্ভ বেশি হলে আমাদের আয়ও একটু বেশি হয়। কিন্তু আধুনিকতার  এই সময়ে রিজার্ভও আগের মতো হয় না। মোট কথা ঢাকার ঐতিহ্য ও পৈতৃক ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ভালোবাসার কারণেই এখনো এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার যদি আমাদের দিকে একটু খেয়াল রাখে তাহলে আমাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। ৩৫ বছর যাবত টমটম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে বর্তমানে করোনার থাবায় এই ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন মামা ভাগিনা টমটম সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী মো. নূর আলম হাওলাদার। তিনি এখন বঙ্গবাজারের বরিশাল প্লাজা মার্কেটের সামনে পান সিগারেটের দোকান দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত এই পেশার সঙ্গে জড়িত থেকে হতাশা ও অভাব ছাড়া আর কিছুই পাননি বলেও জানান নূর আলম হাওলাদার।  করোনার কারণে নিজের ৩৫ বছরের পেশা ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে এ সময় তার কণ্ঠে ফুটে উঠে হতাশার সুর। তিনি বলেন, শুধু আমিই নই. জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমার মতো অনেকেই এই পেশা ছেড়ে বর্তমানে অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ সময় তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, অনেক রিপোর্টারই এসেছেন এবং আমাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। তুলে ধরেছেন বিলুপ্তির পথে টমটমের কথা। কিন্তু আমাদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমরা সেই আগের মতোই আছি।  সরকার যাতে ঢাকার ঐতিহ্য টমটমকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসে- বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে এই আবেদনই জানাচ্ছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর