বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করেছিল বাঙালি। তাই যারা ভাষা নিয়ে দৈন্যতায় ভুগছেন, তাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস জানা প্রয়োজন।

গতকাল বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ আমাদের মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল আজকের এই দিনে। জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সংস্কৃতির ওপর অনেক আঘাত আনা হয়েছিল। আমাদের ভাষা পাল্টে দিয়ে অন্য ভাষা তুলে ধরা হয়েছিল।’

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি শিক্ষা সম্মেলন করা হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হবে। এ খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। তখন এভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়। ভাষার জন্য আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। তিনি বলেন, উজানে নাও ঠেলেই আমাদের যেতে হয়েছে। আর সেভাবেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। সেভাবেই আমরা এগিয়ে যাব। আমরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নতি, সবকিছু মিলিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিজের ভাষা ছাড়া কখনো নিজের মনের কথা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। জাতির পিতা এ কথা বলেছেন, অন্য ভাষা শেখায় তার আপত্তি নেই। মাতৃভাষায় শিক্ষা হলে কোনো কিছু জানা বোঝা বা প্রকাশ করবার সুবিধা অনেক বেশি। পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শিক্ষা নেওয়াও ভালো।

সহজে ভাষা শেখার জন্য একটি অ্যাপস চালু করা হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশ এগিয়ে যাক। আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পেয়েছি। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমার মনে হলো আমাদের ওপর অনেক বড় দায়িত্ব এসেছে। পৃথিবীর অনেক দেশের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভাষার পাশাপাশি এক-দুটা ভাষা আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারে। এখন ডিজিটাল যুগ অনেক সহজেই এগুলো শেখার সুযোগ আছে। ২০০১ সালে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম, সে বছর আমি সরকারে আসতে পারিনি। সে সময় যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা এই কাজ বন্ধ করে দেয়। কেন বন্ধ করেছিল জানি না। তারা অবশ্য ভালোই করেছিল এ কাজ করে। আমি আবার ক্ষমতায় এসে নিজের মতো করে মাতৃভাষা ইস্টিটিউট গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, এটারও ইতিহাস আছে। আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হলো এবং বলা হলো উর্দু নাকি মুসলমানদের ভাষা। আর বাংলা যেখান থেকে এসেছে এটা নাকি হিন্দু ভাষা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য সবকিছু করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জন্য কিছু ফান্ড লাগলেও আমি দেব। গবেষণা ছাড়া কোনো বিষয়ই উৎকর্ষ সাধন করা যায় না। আজকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি গবেষণার ফলেই। সুতরাং এই ইনস্টিটিউটের দরকার সারা বিশ্বে যতগুলো ভাষা আছে সবকিছু সংরক্ষণ করা, গবেষণা করা ও ভাষার ইতিহাস জানা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের কাজের সুবিধার জন্য আমরা ৯টি ভাষার একটি অ্যাপস করে দিয়েছি। ডিজিটাল সিস্টেমে যে কেউ যেন ভাষা শিখতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, শিশুরা তাড়াতাড়ি ভাষা শিখতে পারে। তারা একসঙ্গে দু-তিনটা ভাষা দ্রুত শিখে নেয়। তবে কোনটা ধারণ করবে সেটা আসে পরে। মাতৃভাষায় শিক্ষাটা হলে সবকিছু জানা, বোঝা ও উপলব্ধি প্রকাশ করার উপকার অনেক বেশি।

এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের যুগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা উপার্জন করতে পারছে। আমরা তাদের লার্নিং এবং আর্নিংয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তারা এখন একেবারে ইউনিয়নে বসে বিদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারছে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা আর উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতার অধিকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ ধরনের মানসিক দৈন্যতায় যারা ভোগেন তাদের জন্যই ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তিস্থল জানা একান্তভাবে দরকার। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিশ্বের ১৬টি ভাষায় বহুভাষী পকেট অভিধান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি মাতৃভাষা পিডিয়া তৈরির প্রকল্প গ্রহণ এবং ভাষা-সাহিত্যকর্ম, বাংলা অনুবাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন শীর্ষক একটি প্রামাণ্য চিত্র বিভিন্ন ভাষায় করার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।

পদক প্রদান : অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক’ তুলে দেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান, রঞ্জিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ।

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’র ওপর আলোকপাত করে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। এর আগে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের সংগীত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ পরিবেশিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর