সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

তিন দশকে মরে গেছে উত্তাল মাসকাটা নদী

অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু পাতারহাট বাজার

রাহাত খান, বরিশাল

তিন দশকে মরে গেছে উত্তাল মাসকাটা নদী

মেহেন্দিগঞ্জের একসময়ের উত্তাল মাসকাটা এখন মরা নদী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তিন দশকে মরে গেছে খরস্রোতা একটি নদী। পলি পড়ে ধীরে ধীরে নাব্য কমে এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের একসময়ের উত্তাল মাসকাটা নদী। মরে যাওয়ায় ওই নদীতে যাত্রী এবং পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে অন্য নদী দিয়ে প্রায় ১ ঘণ্টার বেশি পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যেতে হয় দূরপাল্লার লঞ্চগুলোকে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে মেহেন্দিগঞ্জের বৃহত্তম পাতারহাট বাজারে। মরে যাওয়ায় মাসকাটা নদী থেকে জেলেদের মাছ শিকারও বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় পুনঃখনন করে মাসকাটা নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নদীর তীর সংরক্ষণ ও নাব্য রক্ষার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। বিআইডব্লিউটিএ শুধু তাদের নৌ-রুটগুলোর নাব্য রক্ষা এবং নৌ যাত্রীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে। গত তিন দশকে আস্ত একটি নদী মরে গেলেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না কোনো কর্তৃপক্ষের।

বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর সাদেকপুর থেকে মাসকাটা নদীর উৎপত্তি।

৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী একই উপজেলার ভাসানচর বাঘরজা সংলগ্ন কালাবদর নদীতে পতিত হয়েছে। ৯০ দশক পর্যন্ত মাসকাটা নদী হয়ে বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চ চালিয়েছেন প্রথম শ্রেণির নৌযান মাস্টার মো. মজিবর রহমান। তিনি জানান, ’৮১ সালে মাসকাটা নদী দিয়ে নৌবাহিনীর বিএন কর্ণফুলী জাহাজ চালিয়েছেন। ৯০ দশকে বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চ মাসকাটা নদী হয়ে চলাচল করত। এতে ঢাকার দূরত্ব ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার কম ছিল। সময়ও বাঁচত এক ঘণ্টার বেশি। নব্বইয়ের পর ধীরে ধীরে পলি পড়ে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। মাসকাটা এখন মৃত। এক পাশের নালায় স্থানীয় রুটের ছোট লঞ্চ-ট্রলার চলাচল করলেও লঞ্চ থেকে ট্রলারে যাত্রী নামিয়ে তীরে তুলতে হয়। নদীর নাব্য না থাকায় বরিশালের বৃহত্তম পাতারহাট বাজারে পণ্য পরিবহন চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। মেহেন্দিগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ও নেভিগেশন ব্যবসায়ী মেজবাউদ্দিন ফরহাদ বলেন, ৯০ দশকে মাসকাটা এপাড়-ওপাড় পুরোটাই নদী ছিল। কোনো চর ছিল না। এখন জাঙ্গালিয়া থেকে খেয়াঘাট, ধুলিয়া ও মধ্যের চর এলাকায় পলি জমে নদী মরে গেছে। একপাশে নালায় (খালের মতো) একটু পানি প্রবাহ থাকলেও বড় লঞ্চ বা নৌযান চলে না। আগে মেহেন্দিগঞ্জের বড়-ছোট লঞ্চ রাস্তার মাথা এলাকায় নোঙর করত। এখন নদী মরে যাওয়ায় নৌযান সরাসরি রাস্তার মাথায় নোঙর করতে পারে না। ছোট লঞ্চ দূরের নালায় থামিয়ে ট্রলারে যাত্রী পারাপার করতে হয়। পাতারহাট বাজারে পণ্যবাহী বড় নৌযানও যেতে পারে না। নৌপথে পণ্য পরিবহন না থাকায় পাতারহাট বাজার অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। আগে এই নদীতে মাছ শিকার করত জেলেরা। এখন নদী মরে যাওয়ায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে স্থানীয় জেলেদেরও জীবনে নেমে এসেছে দুর্দিন। মেহেন্দিগঞ্জের ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক নেতা সঞ্জয় গুহ বলেন, চারদিকে নদী বিধৌত মেহেন্দিগঞ্জের প্রাণ পাতারহাট বাজার। নদী পথে এই বাজারের পণ্য আনা-নেওয়া হতো। মাসকাটা নদী মরে যাওয়ায় পাতারহাট বাজার এখন জৌলুস হারিয়েছে। পরিবেশের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সব নদ-নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। উজান থেকে ভাটির দিকে পানির স্রোত। কিন্তু মাসকাটা নদী প্রবাহিত পূর্ব-পশ্চিমে। উত্তরের বিভিন্ন নদী থেকে পলি এসে মাসকাটা নদীতে আটকে যায়। ধীরে ধীর নাব্য কমে নদীটি মরে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. সেলিম জানান, চলতি মৌসুমে বরিশালের ৬টি নৌ পথের ৩০টি পয়েন্ট ড্রেজিংয়ের জন্য ড্রেজিং বিভাগে চাহিদা দেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, মাসকাটা নদীর পাতারহাট লঞ্চঘাট এলাকায় দুই মাস ধরে নিজস্ব ড্রেজার চলছে। বিশ্বব্যাংকের আরও একটি ড্রেজার পাতারহাটে আনা হয়েছে। চ্যানেলটি সচল রাখতে দুটি ড্রেজার দিয়ে ৩ লাখ ঘন মিটার পলি অপসারণ করা হচ্ছে। আগামী মৌসুমে চ্যানেলটির ভবিষ্যৎ বোঝা যাবে।

সর্বশেষ খবর