রবিবার, ৭ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

লাগামহীন বখাটে, অনিরাপদ কিশোরী

লজ্জায় আত্মহত্যা করছে অনেক ভুক্তভোগী, বন্ধ হচ্ছে লেখাপড়া, বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবক

জিন্নাতুন নূর

লাগামহীন বখাটে, অনিরাপদ কিশোরী

বখাটেদের উত্ত্যক্ত করার হার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। উত্ত্যক্তকারীরা শুধু বখাটেপনাতেই থামছে না, আক্রমণ চালাচ্ছে ভুক্তভোগী কিশোরী ও তার পরিবারের ওপর। অপমান সইতে না পেরে এই কিশোরীদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। বখাটেদের উৎপাতে নিরুপায় হয়ে কিশোরীদের বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তার পরিবার। কারও কারও লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় অনেক কিশোরীকে ঘরবন্দি জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আদরের মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগে সময় কাটছে অভিভাবকদের।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে মোট ৪০ জন নারী ও কিশোরী উত্ত্যক্তের শিকার হয়। এর মধ্যে আটজন আত্মহত্যা করে। উত্ত্যক্তের পর একজনকে হত্যা করা হয়। উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ৬৪ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। বিভিন্ন কেসস্টাডির তথ্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা কিশোর এবং উঠতি বয়সীরাই উত্ত্যক্ত ও বখাটেপনার সঙ্গে জড়িত। বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, ভাসমান পথশিশু ও টোকাইরাও এসব কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত।

বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ তরুণী ও কিশোরী যৌন নিপীড়ন তথা উত্ত্যক্তের শিকার হয়। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ জানায়, তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়। বিভিন্ন জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ মা, বোন বা বান্ধবী থাকা অবস্থায় এবং ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায়ও উত্ত্যক্ততার শিকার হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের কিশোরীরা কোথাও নিরাপদে নেই। অথচ উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠন করার বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি এখনো আমলে নিচ্ছে না। এর বাইরে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি ইস্যুতে দেশের সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ামাত্রই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা এবং দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ডিসিদের নির্দেশ দেওয়াসহ মোট পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও বখাটেদের উত্ত্যক্ত বন্ধ হচ্ছে না।’

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায় ২ মে স্কুল থেকে ফেরার পথে এক বখাটের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দশম শ্রেণির মুক্তি বর্মণ নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কাউছার মিয়া (২১) নামের এক বখাটেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে মুক্তিকে দীর্ঘদিন ধরে কাউছার উত্ত্যক্ত করে আসছিল। ঘটনার দিন বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে মুক্তিকে কুপিয়ে আহত করে কাউছার।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ২৭ এপ্রিল এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় প্রতিবাদকারীর বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে হৃদয় ইসলাম বাবু (২০) নামের এক বখাটে। এ সময় হামলায় স্কুলছাত্রীর বাবা ও মা আহত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন। জানা যায়, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই এই ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত একই ইউনিয়নের ঝলঝলি গ্রামের বাবু। বিষয়টি স্কুলছাত্রীর পরিবার জানতে পেরে বখাটে বাবুকে সতর্ক করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবুর নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র দিয়ে স্কুলছাত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়।

২৫ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুরে বখাটেদের উত্ত্যক্তে মাসুমা নামের এক স্কুলছাত্রী বিষপানে আত্মহত্যা করে। আন্দিউড়া গ্রামের কিশোর গ্যাং সদস্য নয়ন, ইমন, বিজয় ও আরমান অষ্টম শ্রেণির মাসুমাকে উত্ত্যক্ত করে জোরপূর্বক তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর আগেও প্রায় এক বছর ধরে এই বখাটেরা মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করে আসর্ছিল। পরে মাসুমা অপমান সহ্য করতে না পেরে বিষপান করে।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় বখাটেদের উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে ফাঁস লাগিয়ে অনি রায় নামের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী ২৮ মার্চ আত্মহত্যা করে। এ ছাড়া ১৭ জানুয়ারি পাবনার বেড়া উপজেলায় কলেজে যাওয়ার পথে বখাটের মারধরের শিকার এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। সুস্মিতা খাতুন (১৮) নামের এই শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন।

 

সর্বশেষ খবর