দুঃসহ যানজটের শহর ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নগরবাসীর কাছে আশীর্বাদ হিসেবে এসেছিল। যাত্রীদের যানজট থেকে রেহাই দিয়ে স্বল্প সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয় মেট্রো। আর শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে যাত্রী পৌঁছানোর স্বপ্ন বাস্তব করেছিল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনে নাশকতাকারীরা পরিকল্পিতভাবে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর হামলা চালায়। নাশকতাকারীদের হামলায় মেট্রো ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে এ দুটি গণমুখী সেবা কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ আবার এগুলো চালু হবে সেটিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানাননি। যোগাযোগ ব্যবস্থায় চালু হওয়া যুগান্তকারী এই দুই মাধ্যম চালুর আগে নগরজীবন যেমন থমকে ছিল এগুলো বন্ধ হয়ে আবারও ঢাকার রাজপথ যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ থাকায় ঢাকাবাসীও উপলব্ধি করছেন, এগুলোর কারণে তারা কতটা লাভবান হয়েছিলেন। তবে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কার্যক্রম দ্রুত শুরুর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
টানা তিন দিন সরকারি ছুটির পর সীমিত পরিসরে অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ার পর ঘর থেকে বের হয়ে আসেন কর্মজীবী মানুষসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা। দোকানপাট খুলে যাওয়ায় এবং সড়কে যানবাহনের উপস্থিতি আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসায় গত দুই-তিন দিন নগরীতে তীব্র যানজট হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকায় যারা মেট্রোরেলে চড়ে কর্মস্থলে যেতেন তারা পড়েছেন দুর্ভোগে। সময়মতো যানবাহন না পাওয়ায় অনেকেই দেরিতে কর্মস্থলে পৌঁছাচ্ছেন। যাত্রীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মেট্রোরেল চালু থাকলে তাদের এত দুর্ভোগে পড়তে হতো না। মিরপুর ১১ নম্বর এলাকার এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মেট্রোরেল চালুর পর মতিঝিলে আমার কর্মস্থলে যেতে ৩০ মিনিট সময় লাগত। অফিস শেষে আবার মেট্রোতেই বাসায় ফিরতাম। যা সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয়ী ছিল। কিন্তু এখন মেট্রো বন্ধ থাকায় এর অভাব খুব অনুভব করছি। সিএনজি অটোরিকশা বা রিকশায় যাতায়াত করা খুব ব্যয়বহুল আবার সড়কে যানজটের জন্য অফিসেও নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারছি না।’ মিরপুর শেওড়াপাড়ার গৃহিণী সাহিনা আক্তার তার অসুস্থ মা জুলেখা বেগমকে নিয়ে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য গতকাল বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রতিবেদককে সাহিনা বলেন, ‘মেট্রোরেলে করেই আগে আম্মাকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতাম। আম্মাও এতে স্বস্তি পেতেন। কিন্তু এখন উপায় না থাকায় সিএনজির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ভাড়া খুব বেশি আবার যানজট-গরমে অসুস্থ মাকে নিয়ে এভাবে যেতেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
গত বুধ, বৃহস্পতিবার ও শনিবার রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, ফার্মগেট, বনশ্রী, রামপুরাসহ বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে ধৈর্য হারিয়ে অনেক যাত্রী গণপরিবহন থেকে নেমে হেঁটেই গন্তব্যে যান। এদের বেশির ভাগই ছিলেন কর্মজীবী। কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল মহাখালীতে সাংবাদিকদের বলেন, সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন এক বছরেও চালু করা সম্ভব হবে না। তিনি জানান, মেট্রোরেল কবে নাগাদ চালু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি যন্ত্রপাতি এনে এক বছরেও সচল করা সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, মেট্রোরেলে অফিস চলাকালে প্রতিদিন কয়েক লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পৌঁছাতে যাত্রীদের সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। নাশকতাকারীরা গত ১৯ জুলাই মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর করে এবং স্টেশনের যন্ত্রপাতি লুটপাট করে। এতে স্টেশন দুটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। হামলায় দুটি স্টেশন বন্ধ থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকার পুরো মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। স্টেশন দুটির ই-সিস্টেমের পুরোটাই ধ্বংস হয়েছে। যাত্রীদের দাবি, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া ছাড়া মেট্রোরেলের অন্য স্টেশনগুলো চালু করলে অন্তত উত্তরা ও মতিঝিল থেকে যাওয়া আসা করা লাখ লাখ যাত্রীর কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানান, মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে একটি কমিটি কাজ করছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মেট্রোরেলের পাশাপাশি বন্ধ আছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যান চলাচলও। আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ের দুটি টোল প্লাজায় আগুন দেয় নাশকতাকারীরা। এতে টোল প্লাজা দুটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই দুই টোল প্লাজা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুরো এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ আছে। কবে নাগাদ তা চালু হতে পারে বলা যাচ্ছে না। সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মনজুর হোসেন জানান, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আলাদা একটি কোম্পানি ব্যবস্থাপনা করে। ক্ষতিগ্রস্ত দুটি টোল প্লাজা ছাড়াও এর অন্যান্য স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তার পর এটি চালু হবে। তবে কর্তৃপক্ষ আপাতত এটি চালু করতে পারছে না। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুটি টোল প্লাজায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার কারফিউ পুরোপুরি তুলে না নেওয়া পর্যন্ত এটি সাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, যত দ্রুত সম্ভব এক্সপ্রেসওয়ে চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য এর ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। মূলত ব্যবসায়ী ও বিদেশগামী যাত্রীসহ বিদেশিরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রাস্তা ব্যবহার করেন। এটি বন্ধ থাকায় এই যাত্রীরা বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাদের দীর্ঘ যানজট ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। মগবাজারের এক পোশাক ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে প্রায়ই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যেতে হয়। আমার বাসা থেকে বের হয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে খুব অল্প সময়ে ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু এখন এটি বন্ধ থাকায় খুব ভোগান্তি হচ্ছে।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের কাওলা থেকে শুরু করে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর যে দুটি টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলো কারফিউ তুলে নেওয়ার পরও বন্ধ রাখা হবে। কর্তৃপক্ষ ম্যানুয়াল টোল আদায়ের মাধ্যমে বনানী র্যাম্প খোলার কথা বিবেচনা করছেন। তবে এটি চূড়ান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজারের বেশি যানবাহন এটি ব্যবহার করে। আর এখান থেকে দৈনিক ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা টোল আদায় হয়।